(ইমাম খোমেইনী (র.)-এর শোকানুষ্ঠানে যোগদানকারী দশ বছর বয়সের একটি বালকের অনুভূতির আলোকে রচিত)
সকলের পরিধানেই ছিল কালো পোশাক। যেদিকেই তাকাই না কেন বাড়িঘর আর দালানকোঠা সবই যেন কালো কাপড়ে মোড়া। ফুটপাতের থরে থরে সাজানো ফুলের টব পর্যন্ত। মসজিদের ভেতরে মানুষের ভীড়, বাইরেও মানুষ। সবার চোখে-মুখেই শোকের ছায়া। ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরে এল হুসাইন। মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছতে না পারায় সে খুব অসন্তুষ্ট। সে সিদ্ধান্ত নিল যে, তার বাবা বাড়িতে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে বাড়িতেই থাকবে এবং বাবা ফিরে আসলে তার সাথে মসজিদে যাবে। যদিও সে জানে না যে, তার বাবা কখন বাড়ি ফিরে আসবে।
আগের দিন রাতে হুসাইনের বাবা গিয়েছিলেন মোসাল্লায় (তেহরানস্থ নামাযের ময়দান) লাখো-কোটি শোকার্ত মানুষের সাথে ইমাম খোমেইনীর জানাযায় শরীক হতে। বাড়ি থেকে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে অত্যন্ত দরদমাখা কণ্ঠে হুসাইনের বাবা হুসাইনকে বলেছিলেন : ‘হুসাইন! সম্ভবত আমি আজ রাতে ফিরব না। তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকবে এবং আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কোথাও যেও না।’ হুসাইনের পিতা খুব শীঘ্রই বাড়ি ফিরে আসবেন এবং সে তাঁর সাথে মসজিদে যাবে একথা চিন্তা করে হুসাইন খুবই আশান্বিত হয়ে থাকল।
অবশেষে পিতা ফিরে এলেন। হুসাইন দৌড়ে তাঁর কাছে গিয়ে বলল : ‘সালাম’। হুসাইন তাঁর পিতাকে আগে আর কখনও এ অবস্থায় দেখেনি। হুসাইনের পিতার চোখ ছিল লাল এবং মুখম-লে ছিল শোকের ছায়া।
হুসাইনের বাবা তাঁর কালো জামা থেকে ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলে নিজ হাতে তা ভালোভাবে ধুয়ে নিলেন। তাঁকে খুবই ক্লান্ত ও শোকার্ত দেখাচ্ছিল। এমতাবস্থায় হুসাইনের বাবা তাকে মসজিদে নিয়ে যেতে রাজি নয়। একথা জানতে পেরে হুসাইন খুবই অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা বোধ করতে লাগল। ইমাম খোমেইনীর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকেই হুসাইন নীরবে ও সকলের আগোচরে বহুবার কেঁদেছে। রেডিওতে এই ঘোষণা এবং পবিত্র কোরআন ও শোকসংগীত শুনে শুনে সে খুবই বিমর্ষ ও মর্মাহত। তার পিতা তখনও কাপড় ধৌত করছিলেন। হুসাইন তাঁকে একটি তোয়ালে এনে দিল। হুসাইন হঠাৎ করে বলল : ‘আব্বা! মসজিদে খুব ভীড়। অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভীড়। সেখানে সকলেই ক্রন্দন করছে আর শোক করছে।’ হুসাইনের পিতা শোকার্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন : ‘আমি জানি বৎস, রাতে খাওয়ার পর আমরা সেখানে যাব।’
সমগ্র শহর সেদিন শোক করছিল। হুসাইন ও তার বাবা খুব শান্তভাবে মসজিদের দিকে এগিয়ে গেল। তারা মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে মেহরাবের কাছে এক কোনায় গিয়ে বসল।
মসজিদ ভর্তি মানুষের সেদিনের ক্রন্দন আর আহাজারির শব্দ দেয়াল আর ছাদে আছাড় খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল মসজিদের বাইরে। একটি বালক লোকদের কাছে কুরআন শরীফের কপি পৌঁছে দিচ্ছিল আর তাদের মাথায় গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল। এক শোকার্ত কিশোর মাইকে কবিতা আবৃত্তি করছে আর তার চোখ থেকে পানি ঝরছে। শোকে মুহ্যমান মানুষের মাথা ছিল অবনত আর অতিমাত্রায় কান্নার মধ্যে তাদের ঘাড় কাঁপছিল। এমন সময় একজন বৃদ্ধা হুসাইনকে ডেকে বললেন : ‘খোকা! তুমি এখানে এস।’ হুসাইন জানত যে, এখানে জবাবের কোন প্রয়োজন নেই। সে নিজে থেকেই সাহায্য করতে আগ্রহী ছিল। লোকটি হুসাইনকে গ্লাসসহ একটি পাত্র আনতে বললেন এবং পানির পাত্র আছে এমন আরেক কিশোরের সাথে মিলিত হয়ে লোকদেরকে পানি পান করাতে বললেন।
হুসাইন আগেও বহুবার শুনেছে যে, মসজিদে কোন কাজে সাহায্য করা সওয়াবের কাজ। তাই সে এই কাজ করার সুযোগ পেয়ে খুব খুশি হলো। সে আরো খুশি এজন্য যে, ইমাম খোমেইনীর জন্য সেও কিছু করছে। অবশেষে শোকানুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল এবং শোকার্ত লোকজন ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল। হুসাইন পানির পাত্র ও গ্লাসটি রেখে তার বাবার কাছে ফিরে এল। বাবা হুসাইনকে বললেন : ‘হে পুত্র! তুমি খুব ভালো কাজ করেছ। তুমি ইমামের একজন সৈনিক।’ এক সময় হুসাইন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে : ‘কেন এমন হবে? কেন ইমাম আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন?’ তার চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগল আর তা তার গণ্ডদেশ ভিজিয়ে দিল। সে বিশ্বাসই করতে চাইছিল না যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.) চলে গেছেন। কেউই একথা বিশ্বাস করতে পারে না। হুসাইনের তখন সেই শোকার্ত কিশোরের আবৃত্তি করা একটি কবিতার অংশ বিশেষভাবে মনে পড়ল : ‘আমি একটি ফুলকে হারিয়ে ফেলেছি এবং তা খুঁজছি…’
ইমামের মৃত্যুজনিত যন্ত্রণা হুসাইনের অন্তরকে ব্যথিত করেছে। সে তাই খুবই শোকাহত। কী অপ্রিয় ও তিক্ত এক সত্যকে আজ মেনে নিতে হচ্ছে, ইমাম আর ইহধামে নেই, তার এবং সকলের শ্রদ্ধেয় ইমাম সকলকে ছেড়ে চলে গেছেন। পরে হুসাইন তার পিতার সাথে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে এলো। এটিই শেষ শোক নয়, এ হলো শোকের সূচনামাত্র। কেননা, সারা পৃথিবীতেই যেন শোকের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে।
(নিউজলেটার, আগস্ট ১৯৯১)