শিশুরা হচ্ছে আল্লাহর দেয়া বিশেষ রহমতস্বরূপ। তারা পরিবারে সমৃদ্ধি ও সুখ আনয়ন করে এবং অনেক সময় পারিবারিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমও তারা। অনেক সময় দেখা যায় দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও শিশুদের কারণে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। বিবাহিত জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে একটি শিশু।
ইসলামের বিধান হচ্ছে ২০ বছরে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত সন্তানদের লালন-পালন ও দেখাশোনা করতে হবে। প্রতিটি শিশুর প্রথম সাত বছরের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কারণ, মানুষের জীবনের এই প্রথম সাতটি বছর হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে।
সুখময় শৈশবের গুরুত্ব
যেহেতু শিশুর প্রথম সাত বছর এত গুরুত্বপূর্ণ সেহেতু শিশুর উপর ইতিবাচক পন্থায় প্রভাব রাখার ব্যাপারে পিতা-মাতার অবহেলা ও ভুল ভূমিকার কারণে শিশুরা বিপথগামী হয় এবং অনেক অপরাধ ও অপকর্মের শিকড় এই শৈশবকালের মধ্যেই প্রোথিত। এই সময়ে শিশুরা যে তথ্য পায় তাই বীজ হিসেবে তাদের মনে উপ্ত হয় এবং এ থেকেই বৃক্ষের সৃষ্টি হয় এবং বীজ অনুযায়ী মিষ্ট বা তিক্ত ফল দান করে। এভাবে শৈশবের অভিজ্ঞতাই একটি শিশুর ভাগ্য গড়ার ক্ষেত্রে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে। জন্ম থেকেই শিশুদের সঠিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। জীবনের শুরু থেকেই শিশুরা তাদের অনুভূতির মাধ্যমে অনেক কিছু শিখে ফেলে। পরে সে অন্যদের অনুকরণ করে। জীবনের জন্য যে কোন পর্যায়ের তুলনায় শৈশবকালেই মানুষ শিক্ষার ও খেলাধুলার প্রচুর সময় পায় এবং জানার কৌতুহলও থাকে এ সময়টায় বেশি। শিশুরা চায় তাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের জবাব এবং তারা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কিভাবে হয় তাও জানতে চায়। এই পর্যায়ে শিশুদের জীবনে আচার-আচরণের ভিত্তি রচিত হয়। সে জন্য তাদের প্রশিক্ষণের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।
প্রথম জীবনের শিক্ষা
যেসব বিষয় শিশুদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রয়োজন এবং যেগুলো তাদের বিশুদ্ধতা অর্জন ও বিকাশে অবদান রাখবে সেগুলো তাদের এই সময়ে শিক্ষা দিতে হবে। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ধর্ম, আচরণ ও নিজেকে রক্ষার বিষয় সম্পর্কে শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষা যেন তাদেরকে ক্লান্ত করে না তোলে এ জন্য গল্প, খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের শিক্ষা দান করা প্রয়োজন।
এই সময়কালটায় নৈতিক শিক্ষাদান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেমেয়েদের এমন উপযোগী পরিবেশে গড়ে তুলতে হবে যা প্রথা, ঐতিহ্য, ব্যক্তিগত উত্তম অভ্যাস একটি আদর্শ ভূমিকা রাখবে এবং যেখানে তাদের মানসিক ও আবেগ-অনুভূতির চাহিদাগুলো তাদের মনে জন্ম নিবে।
বঞ্চনা ও ভূল শিক্ষার প্রভাব
প্রতিটি শিশুর মধ্যেই একটি স্পর্শকাতর প্রকৃতি বা স্বভাব বিদ্যমান থাকে। অধিকাংশ শিশুই বরং কিছুটা আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক থাকে। তারা তাদের দাবি যে কোনভাবেই পূরণ হোক সেটা চায়। তবে একটি শিশু যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সে ব্যাপারে অবশ্যই যত্মবান থাকতে হবে। অন্যদিকে শিশুরা যদি বঞ্চনার শিকার হয় এবং আদর-স্নেহ ও সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে তারা সমাজের অনুপযোগী হয়ে গড়ে ওঠে। তাদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে সেটার প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতাও তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে পারে।
কোন কোন ক্ষেত্রে পিতামাতা বা অন্যদের আচার-আচরণ থেকে শিশুরা খারাপ শিক্ষা পেয়ে থাকে এবং এ থেকেই তাদের অপরাধ জীবনের সূচনা হতে পারে। সুতরাং যদি কোন শিশু বা কিশোর অপরাধ করে তাহলে এর উৎস পরিবারের বাইরে কদাচিৎ বিবেচনা করা যেতে পারে। এমনকি একটি শিশু বা কিশোর যদি পারিবারের বাইরেও কোন খারাপ স্বভাব আয়ত্ত করে অপরাধের দিকে ধাবিত হয় তাহলেও পরিবারকে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে এই কারণে যে, পিতামাতা তাদের সন্তানের প্রতি যত্ননেয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা করেছে।
প্রাথমিক অভিজ্ঞতার গুরুত্ব
মনস্তত্ত্ববিদ, অপরাধতত্ত্ববিদ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, শৈশব জীবনের অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত জীবনের জন্য খুবই কার্যকর। এ ছাড়া তাদের ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্বেও এই অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে। অপরাধীদের অধিকাংশই হচ্ছে তারা, যারা তাদের শৈশব জীবনে, বিশেষ করে প্রথম জীবনে ছয় বছরে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। একজন মানুষ সারাজীবন যে সমস্যাসমূহ মোকাবিলা করে তা তার শৈশব জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতারই প্রতিধ্বনি।
বাইরের প্রভাব
শিশুদের জন্য প্রয়োজন পিতামাতার শিক্ষা দান। পিতা বা মাতার স্থান সম্পূর্ণভাবে অন্য কেউ গহণ করতে পারে না। ছেলেমেয়েরা বোর্ডিং, নার্সারি বা হোস্টেলে বাস করতে পারে, এমনকি তারা সেখানে গড়েও উঠতে পারে, কিন্তু তারা কখনো স্বাভাবিক ব্যক্তি হিসাবে গড়ে উঠবে না। নার্স ও নার্সারি কর্তৃপক্ষ সতর্কতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে, কিন্তু তারা ঐসব ছেলেমেয়ের মা হতে পারে না। শিশুদের গড়ে ওঠার ও শিক্ষা লাভের সর্বোত্তম স্থান হচ্ছে পরিবার। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান হচ্ছে নার্সারি, বোডিং বা হোস্টেল। একটি পরিবারের মধ্যে শিশু গড়ে ওঠে সেই পরিবারের কায়দা-কানুন ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে আর নার্সারিতে গড়ে ওঠে সেখানকার কায়দা-কানুন ও সংস্কৃতি অনুযায়ী। এর ফলে শিশু ও পরিবারের মধ্যে সাংস্কৃতিক গ্যাপ বা পার্থক্য সৃষ্টি হয় এবং শিশু অনেক ক্ষেত্রে তার পরিবারের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে ভুলে যায়।
অনুপযোগী পারিবারিক অবস্থা
কোন কোন ক্ষেত্রে শিশু এমন একটি পরিবারে হয়তো বেড়ে ওঠে যেখানে পরিবেশ সম্পূর্ণ অনুপযোগী এবং সেক্ষেত্রে নার্সারির পরিবেশকেই বেছে নেয়া যায়। যে পরিবারে পিতামাতা মাদকাসক্ত কিংবা অন্য পন্থায় দুর্নীতিগ্রস্ত, মদ্যপান, জুয়া খেলা, চুরি বা অন্যান্য অপরাধ কর্মে জড়িত, মানসিক বিকারগ্রস্ত, সবসময়ই ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত সেখানকার পরিবেশ হচ্ছে জঙ্গলের মতো। সেখানে কোন শিশুই স্বাভাবিকভাবে মানুষ হিসাবে গড়ে উঠবে না।
যেসব শিশু এ রকম অনুপযোগী পারিবারিক পরিবেশে লালিত-পালিত হয় তারা কাক্সিক্ষত শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হয় এবং অসংখ্য সমস্যা মোকাবিলা করে। এ ধরনের শিশুদের সামাজিক এবং আবেগ-অনুভূতির জীবন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
(নিউজলেটার, মার্চ-এপ্রিল ১৯৯২)
আলী কায়েমী আমিরী