আত্মপরিচয় ও অন্যপরিচয়

ড. নেয়ামত উল্লাহ ইরান যাদে*

মহাকাব্য নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা এ বিষয়টিতে একমত যে, মহাকাব্যের কাহিনীগুলো কোনো না কোনো একটি জাতির প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তাদের বীরত্ব, কৃতিত্ব ও স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকে।
সময় ও কালের নিরিখে এবং প্রমাণ সাপেক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ জাতীয় মহাকাব্য বলে যেগুলোকে দাবি করা হয় সেগুলো হচ্ছে:
১। গিলগামেশ (Gilgamesh) : এটি প্রায় খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার সালে ব্যবিলনীয় ভাষায় রচিত হয়েছে এবং যার বিষয়বস্তু ছিল বীরদের জন্য এমন এক মৃতসঞ্জীবনী উদ্ভিদ অন্বেষণ করা এবং পরাজিত পাহলাওয়ানদের কাহিনী বর্ণনা করা।
২। ইলিয়াড (Iliad): এটি খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকের মধ্যভাগে হোমার কর্তৃক গ্রিক ভাষায় রচিত হয়েছে যার বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ কাহিনী নিয়ে।
৩। ইনেইড (Aeneid): এটি ভার্জিল কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় রচিত মহাকাব্য-যা রচনা করতে খ্রিস্টর্পূব ২৯ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লেগেছিল। এ মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর ধ্বংস এবং রোম জাতির প্রতিষ্ঠার পর বন্ধুদের সাথে ইনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত এবং ট্রয়ের জনগণ যারা ছিল সংস্কৃতির প্রতীক এবং ল্যাটিন জনগণ যারা ছিল শক্তিমত্তার প্রতীক তাদের উভয়কে ঐক্যবদ্ধ করা।
৪। মহাভারত (Mahabharata): খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাকাব্য।
৫। রামায়ণ (Ramayana): খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় অথবা চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে বাল্মীকি কর্তৃক রামচন্দ্রের জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত মহাকাব্য।
৬। ফেরদৌসির শাহনামা যা হিজরি চতুর্থ শতকে রচিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত মহাকাব্যের বিষয় হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীগুলোর বিশ্লেষণ, মহান বীরযোদ্ধাদের গুণ বর্ণনা এবং বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্মাণে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের আলোচনা করা। যদি মহাকাব্য রচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কেবল বীরদের কীর্তি বর্ণনা করা  হয়  তবে এ বিষয়ের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কিংবা যদি মহাকাব্য আঙ্গিকের কবিতার বিষয় কবি ও পাঠকদের চেয়ে গুরত্ববহ হয় তথাপিও কেন এ আঙ্গিকের সাহিত্য ভিনদেশি ভাষাসমূহে অনূদিত হচ্ছে?
পিছনে ফেলা আসা যুগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, একটি জাতি প্রতিষ্ঠার ঘটনা অথবা নিজের প্রসিদ্ধ বীরত্বগাথা থাকা সত্ত্বেও অন্য জাতির বীরত্বগাথার তথ্য সংগ্রহের পণ্ডিত, চিন্তাবিদ ও সকল জাতির লোকদের প্রয়োজনের রহস্যটা কী?
এখানে যেসকল ভাষায় শাহনামা অনূদিত হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলার মধ্য দিয়ে উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর তুলে ধরার প্রয়াস পাবো।
ফেরদৌসি ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে  শাহনামা রচনা শুরু করেন এবং ৮ মার্চ, ১০১০ খ্রিস্টাব্দে ৩৫ বছর পর ৭৫ বছর বয়সে সমাপ্ত করেন। তিনি বলেন:
আমি দীর্ঘ ত্রিশটি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি
এবং ফারসি ভাষার মাধ্যমে পারস্যকে উজ্জীবিত করেছি।
হিজরি ষষ্ঠ শতকে শাহনামা মূলত দু’টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল একটি জর্জিয়ান ভাষায় আর অপরটি হয়েছিল আরবি ভাষায়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সাথেই বলতে হয় যে, উভয়টিই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রথম আরবি ভাষায় শাহনামা অনুবাদ করেন আসিরুল মামালিক নিশাবুরি যিনি হিজরি পঞ্চম শতকের শেষভাবে এবং ষষ্ঠ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
কাওয়াম উদ্দিন ফাতেহ বিন আলি বিন মুহাম্মাদ বুন্দারি ইস্পাহানি কর্তৃক আরবি ভাষায় অনূদিত কপিটিই হচ্ছে শাহনামার সবচেয়ে পুরাতন অনূদিত কপি যা এখনো আছে। অনুবাদক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তথ্যগুলোই তুলে ধরেছেন এবং বর্ণনাধর্মী বিষয়গুলো ফেলে দিয়েছেন।
৮৪৫, ৯১৬ ও ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় যে ভাষায় শাহনামা অনূদিত হয়েছে তা ছিল ওসমানি তুর্কি ভাষায়। শাহানামা কাব্যগ্রন্থটি ২৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যেমন, আরবি, জার্মানি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, ইতালি, পশতু, তুর্কি, রুশ, জাপানি, হিন্দি, কুর্দি ইত্যাদি।
তৃতীয়ত আমার প্রশ্ন ছিল যদি শাহানামা ইরানের পৌরাণিক ও বীরদের কাহিনী বা ইরান জাতির ইতিহাস হয়ে থাকে তবে অন্যান্য জাতির জন্য এর প্রয়োজনীয়তা কী?
উল্লেখ করা হয়েছে যে, শাহানামার প্রথম যে অনুবাদটি সুলতান ঈসা বিন মুলকে কামেল আবু বকর এর নির্দেশে বুন্দারি করেছেন তা ছিল ইতিহাস নির্ভর। আকর্ষনীয় বিষয় হচ্ছে জার্মানি ভাষায় যখন শাহানামা অনূদিত হয় তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আবার যখন মনিরউদ্দিন ইউসুফ বাংলা ভাষায় শাহনামা অনুবাদ করছিলেন তখন ছিল বাংলাদেশের স্বধীনতা যুদ্ধের সময়।
আমার দৃষ্টিতে মাহাকাব্য নিছক এমন কোনো সাহিত্যকর্ম নয়, যা কেবল মহাকাব্য ধারণ করে আছে এমন জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। মনীষীরা মহাকাব্যের ন্যায় এ ধরনের সাহিত্যকর্মে সকল জাতি ও মানব সভ্যতার আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁদের ভিতরের রহস্যকে নিজদের সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত করেন। তাঁরা মনে করেন অন্য জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বীরত্ব জানার মাধ্যমে আত্মপরিচয় লাভ করা যায় এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাতীয় আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হওয়া যায়। এ সকল মনীষী মহাকাব্যে বিধৃত বীরদের কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে অত্যাচার ও নীপিড়নের বিরুদ্ধে এবং নিজ জাতি ও দেশকে ধ্বংস থেকে রক্ষার উপায় ও অবলম্বন অন্বেষণ করেন।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরদৌসির শাহনামায় যে বিষয়গুলো রয়েছে তা হচ্ছে, বীরদের মানসিকতা, প্রচেষ্টা, জ্ঞান ও বিদ্যা, খোদার আনুগত্য, ন্যায়পরায়ণতা, রাজনীতি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। এতে শিক্ষণীয় অনেক বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে এবং এতে রয়েছে বিশ্বদর্শন।
এ ধরনের সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে প্রতিরোধ, গৌরব, শক্তি ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করা যায়। অন্য জাতির আলোকময় পরিচিতি জানার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে। মনিরউদ্দিন ইউসুফ সেই রহস্যই উদঘাটন করতে চেয়েছেন দীর্ঘ ১৭ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে- যাতে বাঙ্গালী জাতির উন্নয়নে তা সাহয্য করে।

*ইরানিয়ান ভিজিটিং প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অনুবাদ : তারিক সিরাজী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.