“আমাকে রাতে গোসল দিয়ে রাতেই দাফন করো ও কাউকে খবর দেবে না”
ওফাতকালে হযরত আলী (আ.)’র প্রতি হযরত ফাতেমা জাহরা (সা.আ.)’র ওসিয়্যৎ
রাসূলে খোদা (সা.) এর ওফাতের নব্বুই দিনের মতো অতিক্রান্ত হয়েছে। তিন তিনটি মাস রাসূল(স.) এর কন্যা ফাতেমাতুজ্জাহরা (সা) এর জন্যে ছিল যথেষ্ট কষ্টদায়ক। একদিকে রাসূলে খোদার অনুপস্থিতির বেদনা অপরদিকে একদল লোকের অত্যাচার-সবমিলিয়ে তিনি এতো বেশি বিরক্ত ছিলেন যে একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো কাটাচ্ছিলেন তিনি। কেবল একটিমাত্র জিনিসই তাঁকে কিছুটা স্বস্তি দিতো। সেটা হলো নবীজীর দেওয়া একটি প্রতিশ্রুতি। নবীজী মৃত্যুকালে বলেছিলেন: “কন্যা আমার! আমার পরে আমার খান্দান থেকে তুমিই সর্বপ্রথম আমার কাছে আসবে।”
আলী (আ) এবং তাঁর সন্তানদের জন্যে কঠিন সময় কাটছিলো। তিনি এমন এক মহীয়সী নারীকে হারাতে বসেছেন যাঁর উপস্থিতিতে তাঁর জীবনের মুহূর্তগুলো জ্ঞান-বিশ্বাস এবং ধৈর্যের পরাকাষ্ঠায় অলঙ্কৃত হয়ে ছিল। আলী (আ) তাঁর পরম বিশ্বস্ত স্ত্রীকে হারাতে বসেছেন যিনি প্রতি মুহূর্তে তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিলো তিনি এই পার্থিব জগতের সকল দুশ্চিন্তা ভুলতে বসেছেন। আলী (আ) ফাতেমা (সা) এর সর্বশেষ দৃষ্টিকে গভীরভাবে অনুসরণ করছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন এরপর আর তিনি ফাতেমা (সা) এর দৃষ্টির জ্যোতি দেখতে পাবেন না, যেই দৃষ্টি তাঁকে আন্তরিক প্রশান্তি দিতো। ফাতেমা (সা) এর কথায় নিরবতা ভাঙলো। তিনি বললেন: হে আলি! জেনে রাখো আর কয়েক মুহূর্ত পরই আমি আর তোমাদের মাঝে থাকছি না। বিদায় নেবার সময় এসে গেছে। আমার কথাগুলো শোনো। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা নেই এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। বেহেশত এবং জাহান্নামের আগুন সত্য এবং বাস্তব।কিয়ামতের দিন অবশ্যই আসবে। তোমাকে ওসিয়্যৎ করছি , আমার ওফাতের পর আমাকে রাতের বেলা গোসল দিও এবং রাতের বেলা দাফন করো। আর কাউকে খবর দেবে না। এরপর আমার শিয়রে সামনাসামনি বসো এবং কোরআন তিলাওয়াত করো আর দোয়া করো। তোমাকে আল্লাহর হাতে সঁপে যাচ্ছি। আমার সন্তানদের ওপর কিয়ামত পর্যন্ত সালাম এবং দরুদ পাঠালাম।” “তোমার প্রতি সালাম হে ফাতেমা! তোমার প্রতি সালাম হে উভয় জগতের নারীকুল শিরোমণি! সালাম তোমার ওপর হে মহীয়সী নারী! তোমার চিরন্তন পবিত্র জীবন নারীকে দিয়েছে সৃষ্টির সার্থকতা। তোমার উন্নত মর্যাদা আর ঐশী মাহাত্ম্যের ওপর সালাম এবং দরুদ পাঠাচ্ছি।”
ফাতেমা (সা) এর মর্যাদা কেবল এজন্যে নয় যে তিনি ছিলেন নবীজীর কন্যা। বরং তিনি ব্যক্তিগতভাবেই ছিলেন আত্মিক এবং চারিত্রিক গুণে সম্মানীয় ও মর্যাদার অধিকারী। তাঁর এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে কোরআনের উন্নত শিক্ষা এবং তাঁর পিতা রাসূলে খোদা (সা) এর হেদায়েতমূলক পথনির্দেশ।এ নিয়ে কথা বলার আগে বরং হযরত ফাতেমাতুজ্জাহরা (সা) সম্পর্কে কোরআনের যে আয়াতটি নাযিল হয়েছে,সেদিকে ইঙ্গিত করা যাক।হযরত ফাতেমা (সা) এর জন্মের সময় নবীজীর ওপর সূরা কাওসারের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। ফাতেমা (সা) এর জন্মকে আল্লাহ পাক নবীজীর জন্যে “খাইরুন কাসির” বা প্রচুর কল্যাণ বলে অভিহিত করেছেন। একইভাবে সূরা আহযাবের তেত্রিশতম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীর আহলে বাইতের পবিত্রতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। বর্ণিত আছে যে এই আয়াতগুলো নাযিল হবার পর যখনই নবীজি নামায পড়তে মসজিদে যেতেন, ফাতেমা (সা) এর ঘরের দরোজায় এসে বলতেন:” হে আহলে বাইত,নামাযের সময় হয়েছে।” তারপর সূরা আহযাবের তেত্রিশ নম্বর আয়াতটি তিলাওয়াত করতেন। আয়াতটির শেষাংশের অর্থ হলো..”হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে” ।
কোরআনের সাথে নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ফাতেমা (সা)’র চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোরআনের গভীর সমুদ্র থেকে তিনি মূল্যবান সব রত্ন কুড়িয়েছেন। ঐ রতন মানিক দিয়ে তিনি তাঁর জীবন এবং আত্মাকে সাজিয়েছেন। নবীজীর ওফাতের পর মসজিদে দেওয়া তাঁর সর্বপ্রথম বক্তৃতায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে “কোরআন হচ্ছে রাসূলের রেখে যাওয়া অমূল্য সম্পদ এবং মানুষ ও আল্লাহর মাঝে কৃত অঙ্গিকারনামা।” তিনি আরো স্মরণ করিয়ে দেন যে, কোরআনে কোনধরনের মিথ্যা বা সত্যের বিপরীত কিছুর অস্তিত্ব নেই। কোরআন হলো নূরের ভাণ্ডার। এই কোরআন অন্যদেরকে আলো বিলায়। এই কিতাবের তথ্যাবলি সবাই ব্যবহার করতে পারে এবং যার যার জ্ঞানের সামর্থ্য অনুযায়ী কোরআনের মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। কোরআনের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:”এই কোরআনের মর্যাদা এতো বেশি যে যদি কেউ সত্যিকার অর্থে কোরআনের অনুসরণ করে এবং কোরআনের আদেশগুলো মেনে চলে, তাহলে তিনি পূর্ণতার এতো উচ্চ পর্যায়ে আরোহণ করবেন যে, অন্যেরা তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে এবং ঐরকম মর্যাদার শিখরে আরোহণের চেষ্টা করবে।”
ফাতেমা (সা) তাঁর সন্তানদেরকে কোরআনের আলোকে মানুষ করেছেন। সালমান ফার্সি থেকে বর্ণিত আছে, একদিন রাসূলে খোদা (সা) আমাকে একটা কাজে ফাতেমা (সা) এর ঘরে পাঠালেন। তাঁর ঘরে যখন গেলাম,অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। এ সময় ফাতেমা (সা) কে দেখলাম যব গুঁড়ো করছেন কিন্তু মুখে তাঁর কোরআনের আয়াত তিলাওয়াতের গুঞ্জনধ্বনি। অপর এক বর্ণনায় এসেছে, একদিন হযরত আলী (আ) ঘরে ঢুকলেন,শুনতে পেলেন হযরত ফাতেমা (সা) সদ্য অবতীর্ণ কোরআনের একটি আয়াত তিলাওয়াত করছেন। আলী (আ) আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন: এ আয়াত সম্পর্কে কীভাবে তুমি জানতে পেলে? ফাতেমা (সা) জবাবে বললেন: আমাদের ছেলে হাসান আজ আমার বাবার ওপর অবতীর্ণ আয়াতগুলো আমাকে পড়ে শুনিয়েছে।”
ফাতেমা (সা) এর দ্বীনী এবং নীতি-নৈতিকতা সংক্রান্ত বক্তব্য এবং জীবন চরিত ছিল কোরআনের সুষমায় অলঙ্কৃত। তিনি কেবল যে বলতেন তাই নয়, বরং সামাজিক বাস্তবতার আলোকে কোরআনের নির্দেশনাগুলো বাস্তব জীবনে মেনে চলতেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে মিথ্যা এবং জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন। আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। তাঁর কথাবার্তা, আচার-আচরণে তা ফুটে উঠতো। তিনি “ক্বাদ আফলাহা মান তাযাক্কা”-অর্থাৎ সেই সাফল্য লাভ করবে,যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে-এই আয়াতটির ওপর আমল করতেন। তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছিল এই আয়াতের প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন। #