১১ জিলকদ ইমাম আলী আর রেযা (আ.)-এর জন্মদিন। ১৪৮ হিজরির এই দিনে তিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। ঐ বছরে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার।
ইমাম রেযা (আ.)-এর পুরো নাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা। আলী ছিল মূল নাম আর রেযা ছিল তাঁর উপাধি। ‘আবুল হাসান’ বলে তাঁর একটি ডাকনামও ছিল।
সপ্তম ইমাম হযরত মূসা আল-কাযেম (আ.) ছিলেন ইমাম রেযার পিতা এবং উম্মুল বানিন নাজমা ছিলেন তাঁর মাতা।
ইমাম রেযা (আ.) ছিলেন ইসলামের নবুওয়াতি ধারার অষ্টম ইমাম। জীবনের প্রথম ৩৫ বছর তিনি তাঁর পিতা ইমাম মূসা আল-কাযেম (আ.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করেন। তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্যাবলি এবং হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)-এর সৌজন্য ও মহানুভবতার এক জীবন্ত উদাহরণ।
তদানীন্তন ক্ষমতাসীন সরকার ইমামত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আগ্রাসী চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। সপ্তম ইমাম হযরত মূসা কাযেম (আ.) তা ভালো করেই জানতেন। সে মোতাবেক তিনি জীবদ্দশায়ই হযরত আলী রেযাকে একশ’ একাত্তর জন বিশিষ্ট ধর্মবেত্তার উপস্থিতিতে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর সন্তানদের এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে ডেকে তাদেরকে ইমাম রেযা (আ.)-এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বলেন এবং তাঁর পর সমস্ত বিষয় তাঁর (ইমাম রেযা) কাছে পেশ করতে বলেন। তিনি ইমাম রেযাকে তাঁর উত্তরাধিকার ঘোষণা সংক্রান্ত একটি লিখিত দলিলও রেখে যান। অন্তত ১৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ঐ দলিলে সাক্ষ্য দেন। ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর মৃত্যুর পর ইমামত নিয়ে সম্ভাব্য যে কোন ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিরসনের মহান ইমাম এসব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ইমাম মূসা কাযেম যখন কারাগারে ছিলেন তখন তাঁকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বিষ প্রয়োগ করা হলে ১৮৩ হিজরির ২৫ রজব তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং ঐ দিন ইমাম রেযা (আ.) মুসলিম বিশ্বের অষ্টম ইমাম হন। সে সময় খলিফা ছিলেন হারুনুর রশীদ। হারুনুর রশীদ সরকারের অধীনে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পবিত্র কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপনের এক বিরাট দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়। সে সময় বহু ঈমানদার লোককে কারাবন্দি করা হয় যারা মুক্তি পায় এবং যাদেরকে জেলে দেয়া যায়নি তাদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়। ইমাম রেযা (আ.) সবচেয়ে কোলাহলপূর্ণ সময়ের মধ্যেও শান্তিপূর্ণ পন্থায় মহানবী (সা.)-এর মিশন পরিচালনা করেন। আর এটা সম্ভব হয়েছিল মহানবী (সা.)-এর শিক্ষার ভিত্তিতে তাঁর নিরলস কর্ম প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এর ফলে তাঁর ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বিপুল আকার ধারণ করে।
ইমাম রেযা (আ.) তাঁর পূর্বসূরির কাছ থেকে উন্নত গুণাবলির অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি। বহু ভাষার ওপর তাঁর পূর্ণ দখল ছিল। ইবনুল আসির আল-জাজারি লিখেছেন, ‘ইমাম রেযা (আ.) নিঃসন্দেহে ছিলেন দ্বিতীয় হিজরির একজন মহান জ্ঞানী, দরবেশ ও মুজতাহিদ।’
একবার খোরাসানে যাওয়ার পথে খলিফা আল মামুনের সৈন্যরা যখন তাঁকে মদীনা থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন নিশাবুরে তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামেন। সে সময় অসংখ্য লোক তাঁর চারিদিকে ভীড় জমায়। মহান ইমামকে এক নজর দেখা এবং তাঁর কথা শোনার জন্য সকল রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সে আমলের দু’জন বিশিষ্ট আলেম আবু যার আর-রাযি ও মুহাম্মাদ ইবনে আসলাম আত-তূসী ভীড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে এসে ইমামকে সেখানে কিছু সময়ের জন্য থামার আবেদন জানান যাতে ঈমানদার লোকেরা তাঁর কথা শুনতে পারে। তাঁরা সমবেত জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কিছু বলার জন্যও ইমামকে অনুরোধ করেন। ইমাম তাঁদের অনুরোধ রক্ষা করে বিশাল সমাবেশর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র যথার্থ ব্যাখ্যা পেশ করেন। আল্লাহর বাণী উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, কালেমা হচ্ছে আল্লাহর দুর্গ এবং কেউ এই দুর্গে প্রবেশ করলে সে তাঁর ক্রোধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন।
কিছু সময়ের জন্য থেমে তিনি পুনরায় বলেন, এই দুর্গে প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে এবং এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শর্ত হচ্ছে সমসাময়িক কালের ইমামের প্রতি আন্তরিকতার সাথে ও পুরোপুরিভাবে আনুগত্য প্রকাশ করা। ইমাম রেযা (আ.) খুব সাহসিকতার সাথে ও খোলাখুলিভাবে জনসাধারণের সামনে ব্যাখ্যা করেন যে, মহানবী (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি কোন রকম আনুগত্যহীনতা থাকলে এই দুর্গে প্রবেশের অধিকার থাকে না। তিনি বলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের একমাত্র পন্থা হলো মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতকে মেনে চলা। আর সেটাই হলো মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ।
ইমাম রেযা যে কত জনপ্রিয় ছিলেন উপরে উল্লিখিত ঘটনায় তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে। ইমামের প্রতি ব্যাপকভাবে মুসলমানদের ভালোবাসা, আনুগত্য ও শ্রদ্ধা প্রকাশিত হয়। তদানীন্তন শাসক আল-মামুন এই সত্য বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি যদি এই মহান ইমামের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করেন তাহলে তিনি বেশি দিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না। তাঁর গোয়েন্দা বিভাগও তাঁকে সুস্পষ্টভাবে অবহিত করে যে, ইরানী জনগণ সত্যিকার অর্থেই আন্তরিকতার সাথে ইমাম রেযা (আ.)-এর প্রতি আনুগত্য পোষণ করে এবং তিনি (বাদশাহ মামুন) কেবল ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলে ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করলে জনগণকে জয় করতে পারবেন। আল-মামুন ছিলেন অত্যন্ত চতুর ব্যক্তি। তিনি ইমাম রেযা (আ.)-কে দাওয়াত দিলেন এবং খেলাফত গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন। ইমামকে একটি রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে তলব করে মদীনা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং আল-মামুনের দরবারে হাজির করা হয়। অথচ মদীনায় ইমাম শান্তিপূর্ণ জীবনই যাপন করছিলেন।
দরবারে উপস্থিত হলে মামুন ইমাম রেযা (আ.)-এর প্রতি ব্যাপক আতিথেয়তা ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে বলেন : ‘আমি খেলাফত থেকে অব্যাহতি নিতে চাই এবং আপনার কাছে ক্ষমতা অর্পণ করতে চাই।’ কিন্তু ইমাম রেযা (আ.) তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরে এক চিঠিতে আল-মামুন পুনরায় তাঁর প্রস্তাব দিয়ে লিখেন : ‘আমি আপনাকে যে প্রস্তাব দিয়েছি তা যদি আপনি প্রত্যাখ্যান করেন,তাহলে আমার মৃত্যুর পর অবশ্যই আপনাকে তা গ্রহণ করতে হবে।’ কিন্তু ইমাম রেযা অত্যন্ত জোরালোভাবে পুনরায় তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে আল-মামুন তাঁকে তলব করেন। সে সময় তাঁর সাথে ছিলেন রাষ্ট্রের দু’টি বিভাগের (সামরিক ও বেসামরিক) দায়িত্বে নিয়োজিত ফজল ইবনে সুহাইল। ঐ সময় আর কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিল না। মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে বললেন : ‘আমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখেছি, মুসলিম সমাজের কর্তৃত্ব আপনার ওপর অর্পণ করা এবং আপনার ওপর কর্তৃত্ব অর্পণ করে দায়িত্ব থেকে আমার অব্যাহতি নেয়াই উপযুক্ত কাজ হবে।’ এ কথার প্রেক্ষিতে ইমাম রেযা (আ.) পুনরায় প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে মামুন তাঁর সাথে হুমকির ভঙ্গিতে কথা বলেন। তিনি বলেন : ‘ওমর ইবনুল খাত্তাব (উত্তরাধিকার নিয়োগের জন্য) একটি পরামর্শ পরিষদ (শুরা) গঠন করেছিলেন। তার মধ্যে আপনার পূর্বপুরুষ আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিবও ছিলেন। ওমর ঘোষণা করেন, কেউ যদি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তাহলে তাঁকে মৃত্যুদ- দেয়া হবে। সুতরাং আপনি আমার প্রত্যাশা মোতাবেক এ প্রস্তাব গ্রহণ না করে সরে যেতে পারেন না। আপনার প্রত্যাখ্যানকে আমি মেনে নিব না।’
জবাবে ইমাম রেযা (আ.) বলেন : ‘আমি কেবল উত্তরাধিকার হওয়ার প্রশ্নেই আপনার দাবি মোতাবেক এই শর্তে রাযি হতে পারি যে, আমি কোন হুকুম জারি করব না, কোন নির্দেশ দেব না, কোন আইনগত সিদ্ধান্ত নেব না, বিচার করব না, কাউকে নিয়োগ বা বরখাস্ত করব না এবং বর্তমানে যা যে অবস্থায় আছে তা থেকে কোন পরিবর্তন হবে না।’ মামুন এসবই মেনে নেন।
যেদিন মামুন ইমাম রেযা (আ.)-এর কাছে বায়াত গ্রহণের আদেশ দেন সেদিন সেখানে উপস্থিত ইমামের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী বর্ণনা করেন : “আমি সেদিন তাঁর সামনে উপস্থিত ছিলাম। যা ঘটেছিল তাতে আমার মধ্যে খুশির অনুভূতি দেখে তিনি আমার দিকে তাকান। তিনি আমাকে আরো কাছে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন। আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং অন্য কে যেন শুনতে না পারে এমনভাবে তিনি বললেন : ‘এই ব্যাপারটি দিয়ে তোমার অন্তরকে আচ্ছন্ন করো না এবং এতে খুশি হয়ো না। এটি এমন কিছু যা দিয়ে কিছু অর্জন করা যাবে না’।”
আল-মামুনের উত্তরাধিকার ঘোষণার পর ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্য একটি জাঁকজমকপূর্ণ রাজকীয় দুনিয়াবি জীবনযাপন করার সকল সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি বস্তুগত ভোগবিলাসের দিকে মোটেই আগ্রহ দেখাননি; বরং মহানবী (সা.) ও পবিত্র কুরআন ও অন্যান্য জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। তিনি অধিকাংশ সময় আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও জনগণের সেবায় অতিবাহিত করেন।
শাহি দরবারে তাঁকে প্রদত্ত মর্যাদার সুবাদে ও সুযোগ-সুবিধা পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ইমাম রেযা (আ.) কারবালার শহীদদের স্মরণে সমাবেশের আয়োজন করতেন। এ ধরনের সমাবেশ আগে অনুষ্ঠিত হতো ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকের (আ.) ও ইমাম জাফর আস-সাদেক (আ.)-এর সময়ে। ইমাম রেযা (আ.) ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের মর্মান্তিক দুঃখ-যাতনা ও আত্মত্যাগের নৈতিক দিকসমূহ বিধৃত প্রভাব সৃষ্টিকারী মর্সিয়া রচয়িতাদেরকে উৎসাহিত করে ঐ সমাবেশে নতুনতর প্রাণ সঞ্চার করেন।
আল-মামুন ইমামের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। তিনি ইমামকে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছিলেন কেবল তাঁর অতি উচ্চাভিলাষ ও পাপপূর্ণ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে এবং তাঁর চতুরতাপূর্ণ পরিকল্পনার প্রতি ইমামের অনুমোদন নিতে। কিন্তু ইমাম ইসলামের শিক্ষাবিরোধী কোন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির প্রতি অনুমোদন দেয়া থেকে স্বাভাবিক কারণেই অস্বীকার করেন। এতে আল-মামুন তাঁর প্রতি হতাশ হন এবং নিজে টিকে থাকার স্বার্থে চিরতরে ইমামের জনপ্রিয়তা রোধকল্পে পুরানো কায়দায় তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। খুব সূক্ষ্মভাবে এই অপকর্ম সম্পাদনের জন্য আল-মামুন ইমাম রেযাকে এক নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান এবং আঙুরের সাথে বিষ খাওয়ান। এতে ২০৩ হিজরির ১৭ সফর ইমাম শাহাদাত বরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।