সৌভাগ্যের সোপান

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র, উত্তরাধিকারী ও সঙ্গী আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেছেন: {অডিও শুনতে লেখার উপর ক্লিক করুন>>>>>  }

হে আলী! ইয়াকীন (তথা অবিচল বিশ্বাস)-এর একটি চিহ্ন হলো আল্লাহকে রাগান্বিত করে কাউকে খুশী করবে না। আর আল্লাহ্ তোমাকে যা দান করেছেন তার জন্য কাউকে প্রশংসা করবে না। আর যা তোমাকে দেননি সেজন্য কাউকে ভর্ৎসনা করবে না। কারণ, কোনো লোভীর লোভ জীবিকা আনতে পারে না, আবার কোনো অনিষ্টকামীর অপছন্দ তা রুখতে পারে না। নিশ্চয় মহান আল্লাহ্ স্বীয় প্রজ্ঞা ও মর্যাদায় আনন্দ এবং খুশীকে ইয়াকীনের মধ্যেই নিহিত রেখেছেন। আর দুঃখ এবং কষ্টকে নিহিত রেখেছেন সন্দেহ আর ক্রোধের মধ্যে।

হে আলী! আসলে মূর্খতার চেয়ে দারিদ্র্য আর কিছু নেই। আর বিচক্ষণতার চেয়ে ফলদায়ক আর কোনো সম্পদ নেই। স্বার্থপরতার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কোনো একাকিত্ব নেই। আর পরামর্শের চেয়ে ভালো কোনো সহযোগিতা নেই। চিন্তা করার মতো কোনো বুদ্ধিবৃত্তি নেই। আর সচ্চরিত্রের মতো কোনো বংশ পরিচয় নেই। আর চিন্তার মতো কোনো ইবাদত নেই।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! কথার রোগ হলো মিথ্যা আর জ্ঞানের রোগ বিস্মৃতি, ইবাদতের রোগ অলসতা, দানের রোগ করুণা দেখানো ও এ জন্য গর্ব করা, সাহসিকতার রোগ অত্যাচার, সৌন্দর্যের রোগ অহংকার আর বংশের রোগ বড়াই।

হে আলী! সত্যের ওপর থাকবে। তোমার মুখ দিয়ে যেন কখনো মিথ্যা বের না হয়। কখনো বিশ্বাসঘাতকতা বা খিয়ানতের দুঃসাহস করো না। আল্লাহকে এমনভাবে ভয় করো যেন তুমি তাঁকে দেখছ। তোমার জান-মালকে দীনের জন্য উৎসর্গ করো। সৎ চরিত্রের অধিকারী হও এবং সেগুলোকে কাজে লাগাও। আর অসৎ চরিত্রের সঙ্গ বর্জন করে চল এবং তা থেকে দূরে থাক।

হে আলী! আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয় কাজ তিনটি : যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশিত ফরজ কাজগুলো পালন করে সে হলো সবচেয়ে আবেদ লোক, আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে বেঁচে চলে সে হলো সবচেয়ে সংযমী মানুষ। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তার জন্য যে জীবিকা নির্ধারিত করেছেন তাতেই তুষ্ট থাকে, সে হলো সবচেয়ে সামর্থ্যবান ব্যক্তি।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তিনটি কাজ উত্তম চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত: যে ব্যক্তি তোমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে তার সাথে সম্পর্ক গড়বে, যে তোমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে তুমি দান করবে আর যে তোমার প্রতি অন্যায় করেছে তাকে তুমি ক্ষমা করবে।

হে আলী! পরিত্রাণকারী তিনটি: তোমার জিহ্বাকে সংযত রাখবে, তোমার ভ্রান্তির জন্য ক্রন্দন করবে আর (ফিতনার সময়) তোমার ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করবে।

হে আলী! কর্মের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় তিনটি: তোমার নিজের থেকে লোকজনের প্রতি ন্যায্য আচরণ করবে, আল্লাহর কারণে তোমার ভাইয়ের সাথে সমান হবে। আর সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করবে।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! আল্লাহর সৌন্দর্য তিনটি বিষয়ে: যে ব্যক্তি আল্লাহর কারণে তার মুমিন ভাইয়ের সাক্ষাতে গমন করে অর্থাৎ সে আল্লার জিয়ারতকারী। আর আল্লাহর জিয়ারতকারীর সম্মান রক্ষা করা আল্লাহরই কর্তব্য। তাই সে যা কামনা করে তিনি তা দান করেন। যে ব্যক্তি নামায পড়ে অতঃপর দোয়া-দরুদ ও মোনাজাতে অতিবাহিত করে পরবর্তী নামায পর্যন্ত। অতএব, সে আল্লাহর মেহমান। আর আল্লাহর মেহমানের সম্মান রক্ষা করা আল্লাহরই কর্তব্য। আর হজ্ব এবং ওমরাহ্ এ দু’টি হলো আল্লাহর কাছে দূতের আগমন। আর আগন্তুক দূতের মর্যাদা রক্ষার কর্তব্য আল্লাহরই।

হে আলী! তিনটি কাজের সওয়াব দুনিয়া ও আখিরাতে বিস্তৃত: হজ্ব যা দারিদ্র্য দূর করে, সদকাহ্ যা বিপদ থেকে রক্ষা করে আর আত্মীয়ের সম্পর্ক জোড়া লাগানো যা আয়ু বৃদ্ধি করে।

হে আলী! তিনটি জিনিস রয়েছে যা কোনো ব্যক্তির মধ্যে না থাকলে তার কর্ম সফল হয় না: আত্মসংযম যা তাকে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অবাধ্যতা থেকে বাঁচায়, বিদ্যা যা তাকে নির্বুদ্ধিতার অজ্ঞতা থেকে রক্ষা করে, আর বুদ্ধিমত্তা যা দিয়ে মানুষের সাথে সে মানিয়ে চলবে।

হে আলী! তিন শ্রেণীর লোক কিয়ামতের দিন আরশের ছায়ায় থাকবে: যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য সেটাই চায় যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। যে ব্যক্তি কোনো কাজের মুখোমুখি হলে ততক্ষণ পর্যন্ত সে কাজে পা বাড়ায় না কিংবা পিছিয়ে আসে না যতক্ষণ সে না জানে যে, কাজটি আল্লাহর পছন্দের নাকি অপছন্দের। আর যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের ছিদ্রান্বেষণ করতে যায় না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ত্রুটিটি নিজের মধ্যে থেকে সংশোধন না করে ফেলে। কেননা, যখনই একটি ত্রুটি সংশোধন করে নেয় নতুন আরেকটি ত্রুটি দৃষ্টিগোচর হয়। সুতরাং মানুষের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

হে আলী! পুণ্যের দরজা তিনটি: মনের উদারতা, মিষ্ট ভাষা, আর কষ্ট ও উৎপাতে ধৈর্যধারণ।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তাওরাতে চারটি কথার পাশে আর চারটি বাণী রয়েছে : যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি মোহগ্রস্ত হয় সে আল্লাহর ওপর রাগান্বিত হয়ে (দিনাতিপাত করে)। যে ব্যক্তি তার ওপর নিপতিত বিপদের জন্য অভিযোগ করে সে আল্লাহর বিরুদ্ধেই নালিশ করে। যে ব্যক্তি কোনো ধনাঢ্যের নিকট এসে নিজেকে হীন করে তার এক-তৃতীয়াংশ ঈমান বিনষ্ট হয়ে যায়। আর এ উম্মতের মধ্যে দোযখে যাবে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে উপহাস ও খেলনার পাত্র বানাবে।

চারটি জিনিসের পাশে চারটি জিনিস থাকে : যে রাজা হয়, সে স্বেচ্ছাচারিতা করে, যে পরামর্শ করে না অনুতপ্ত হয়, যেমন আচরণ করবে তেমনই আচরণ পাবে, আর অভাব হলো বড় মৃত্যু। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, স্বর্ণ-রৌপ্যের অভাব? উত্তরে বলেন : দীন-এর (ধর্মীয় জ্ঞান ও ঈমানের) অভাব।

হে আলী! কিয়ামতের দিন প্রত্যেক চোখই ক্রন্দনরত থাকবে তিনটি চোখ ব্যতীত : যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় বিনিদ্র রাত কাটায়, যে চোখ আল্লাহর নিষিদ্ধ হারাম থেকে অবনত থাকে, আর যে চোখ আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ঝরায়।

হে আলী! ধন্য সেই মুখমণ্ডল যার দিকে আল্লাহ্ তাকিয়ে দেখেন যে, এমন পাপের জন্য সে ক্রন্দনরত যে সম্পর্কে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কেউ খবর রাখে না।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! তিনটি জিনিস ধ্বংসকারী। আর তিনটি বিষয় পরিত্রাণ দানকারী : ধ্বংসকারী তিনটি হলো: রিপুর কামনা যার অনুসরণ করা হয়, কৃপণতা যা মেনে চলা হয় আর মানুষের আত্ম-পূজা। অপরদিকে পরিত্রাণ দানকারী তিনটি বিষয় হলো: সন্তুষ্টি ও ক্রোধের মধ্যে ন্যায়পরায়ণ থাকা, সামর্থ্য ও অভাবের মধ্যে মিতচারী হওয়া, আর গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করে চলা যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর যদি তুমি না দেখতে পাও, তিনি তোমাকে দেখছেন।

হে আলী! তিনটি ক্ষেত্রে মিথ্যা সুন্দর: (ন্যায়, সত্য ও ধর্মের পথে পরিচালিত) যুদ্ধে ধোঁকাবাজি, তোমার স্ত্রীকে (সন্তুষ্ট করার জন্য) প্রতিশ্রুতি দান, আর মানুষের মধ্যে মীমাংসার কাজে।

হে আলী! তিনটি ক্ষেত্রে সত্য কুৎসিত: (মনোমালিন্য বা দ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে সহায়ক) একের কথা অন্যকে বলা, কোনো পুরুষকে তার স্ত্রী (বা পরিবার) সম্পর্কে (অপছন্দনীয়) সংবাদ দেয়া এবং কোনো সৎ কাজের দাবীদার ব্যক্তির দাবীকে অস্বীকার করা।

হে আলী! চারটি কাজ অনর্থক: পূর্ণ উদরে আহার করা, উজ্জ্বল চন্দ্রের উপস্থিতিতে আলো জ্বালানো, লবণাক্ত জমিতে চাষ করা এবং অপাত্রে উপকার করা।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, হে আলী! চার ধরনের লোক রয়েছে যাদের দ্রুত শাস্তি দেয়া হয়: যে ব্যক্তির প্রতি তুমি উপকার করো, অথচ প্রতিদানে সে তোমার অপকার করে, যে ব্যক্তির ওপর তুমি জুলুম করো না, কিন্তু সে তোমার ওপর অত্যাচার করে, যে ব্যক্তির সাথে তুমি চুক্তিবদ্ধ হও এ ইচ্ছা বা সংকল্প নিয়ে যে তুমি চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে আর তার সংকল্প হলো চুক্তি ভঙ্গ করা, আর যে ব্যক্তির সাথে তুমি আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া লাগাও, অথচ সে সম্পর্ক ছিন্ন করে।

হে আলী! চারটি জিনিস যার মধ্যে থাকে তার ইসলাম পরিপূর্ণ হয়: সততা, কৃতজ্ঞতা, লজ্জা এবং সদাচরণ।

হে আলী! মানুষের কাছে নিজের অভাব বা চাহিদাগুলো কম প্রকাশ করাই হলো নিরভবতা আর মানুষের কাছে নিজের অভাবগুলো বেশি প্রকাশ করাই হল লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য।

অত্যাচারীর চি‎হ্ন তিনটি: অধীনকে দমন, ঊর্ধ্বতনকে অমান্য, আর অত্যাচারীদের সাথে আঁতাত করা।

নিজেকে জাহিরকারীর চি‎হ্ন তিনটি: লোকজনের সামনে তৎপরতা দেখানো, একাকী থাকলে আলসেমি করা আর সবাই তার কাজে বাহবা দিক সেটাই পছন্দ করে।

মুনাফিকের চি‎হ্ন তিনটি: কারো কথা বর্ণনার সময় মিথ্যারোপ করা, আমানত রাখা হলে তার খেয়ানত করা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করা।

রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে আরো বলেছেন, হে আলী! অলসের চি‎হ্ন তিনটি: এতটা ঢিলেমি করা যে দায়িত্ব অবহেলায় পর্যবসিত হয়, আর এতটা অবহেলা করা যে (সম্পদ ও সুযোগ) নষ্ট হয়ে যায়, আর এ অবস্থায় পাপীতে পরিণত হওয়া।

আর বিচক্ষণ লোকের জন্য তিনটি উদ্দেশ্য ছাড়া কাজে ব্রত হওয়া মানায় না: জীবন-জীবিকা নির্বাহ অথবা পরকালের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ অথবা হারাম নয় এমন পথে উপভোগ করা।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে আরো বলেছেন:

হে আলী! নিশ্চয় মূর্খতার চেয়ে কোনো দারিদ্র্য নেই, বিচক্ষণতার চেয়ে ফলদায়ক সম্পদ নেই, স্বার্থপরতার চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো একাকীত্ব নেই, পরামর্শের চেয়ে ভালো কোনো সহযোগিতা নেই, চিন্তা করার ন্যায় কোনো বুদ্ধিবৃত্তি নেই, সচ্চরিত্রের ন্যায় কোনো বংশ মর্যাদা নেই। আর চিন্তার মতো কোনো ইবাদত নেই। নিশ্চয় কথার রোগ হলো মিথ্যা, জ্ঞানের রোগ হলো বিস্মৃতি, আর দানের রোগ হলো করুণার গর্ব (বলে বেড়ানো ও খোঁটা দেয়া)। সাহসিকতার রোগ অত্যাচার, সৌন্দর্যের রোগ অহংকার আর বংশের রোগ বড়াই।

হে আলী! যখন নতুন চাঁদ দেখবে তখন তিনবার তাকবীর দিবে এবং বলবে : ‘আলহামদু লিল্লাহিল্লাযি খালাকানী ওয়া আলাকাকা ওয়া কাদ্দারাকা মানাযিলা ওয়া জাআলাকা আয়াতাল্লিল আলামীন’ (অর্থ : আল্লাহর প্রশংসা যিনি আমাকে এবং তোমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমার জন্য বিভিন্ন প্রহর নির্ধারণ করেছেন আর গোটা জগতবাসীর জন্য তোমাকে করেছেন নিদর্শন)।

হে আলী! যখন আয়নায় তাকাবে তখন তিনবার তাকবীর দিয়ে বলবে : আল্লাহুম্মা কামা হাসসানতানি খল্কি ফা হাসসিন খুলকি। অর্থ : হে আল্লাহ্! আমার সৃষ্টিকে যেমন সুন্দর করেছেন সেভাবে আমার চরিত্রকেও সুন্দর করুন।

হে আলী! কোনো বিষয় যখন তোমাকে ভীত করে দেয় তখন বলবে : আল্লাহুম্মা বি হাক্কি মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আলে মুহাম্মাদিন ইল্লা ফাররাজতা আন্নি। অর্থ : হে আল্লাহ্! মুহাম্মদ এবং আলে মুহাম্মদের উসিলায় আমাকে নিরাপদ করুন।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে আরো বলেছেন:

হে আলী! তোমার চলার পথে যদি কোনো সাপ দেখ, হত্যা করবে। কারণ, আমি জ্বিনের সাথে শর্ত করেছি তারা সাপের বেশে আত্মপ্রকাশ করবে না।

হে আলী! দুর্ভাগ্যের চি‎হ্ন চারটি: শুষ্ক চোখ ( তথা যে চোখ আল্লাহর ভয়ে ও মুমিনদের কষ্ট দেখে ক্রন্দন করে না), কঠিন অন্তর, উচ্চ অভিলাষ, আর দুর্দশাগ্রস্ত হয়েও দুনিয়াকে ভালোবাসা।

হে আলী! যখন তোমার সামনেই তোমার প্রশংসা করা হয়, তখন বলবে: হে আল্লাহ্! তারা আমার সম্পর্কে যেমনটা ধারণা করে, আমাকে তার চেয়ে উত্তম করে দাও আর আমার সম্পর্কে যেগুলো জানে না সেগুলোকে ক্ষমা করে দাও, আর আমার সম্পর্কে যা বলে সে ব্যাপারে আমাকে পাকড়াও করো না।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে আরো বলেছেন: হে আলী! যখনই সহবাস করবে তখন বলবে : হে আল্লাহ্! আমাকে শয়তান থেকে দূরে রাখ আর আমাদেরকে যা দান করবে তার থেকে শয়তানকে দূর করে দাও। তা হলে তোমাদের ভাগ্যে যদি কোনো সন্তান লিপিবদ্ধ হয়, তা হলে শয়তান তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

হে আলী! লবণ দিয়ে খাওয়া শুরু করবে এবং লবণ দিয়েই শেষ করবে। কারণ, লবণ ৭০ টি রোগ প্রতিরোধ করে যার মধ্যে ন্যূনতম হলো বুদ্ধি প্রতিবন্ধীত্ব, কুষ্ঠরোগ এবং শ্বেতরোগ।

রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে আরো বলেছেন, হে আলী! শরীরে তেল মালিশ করবে। কারণ, যে ব্যক্তি শরীরে তেল মালিশ করে ৪০ দিন শয়তান (বা জীবাণু) তার কাছাকাছি হয় না।

হে আলী! স্বীয় স্ত্রীর সাথে চন্দ্রের প্রথমা আর মাসের মধ্যরাতে সহবাস করো না। তুমি কি দেখ না যে, যারা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী হয়, তারা অধিকাংশই প্রথমা আর মধ্য মাসের জাতক।

হে আলী! যখন তোমার কোনো পুত্র বা কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করে তখন তার ডান কানে আযান এবং বাম কানে ইকামাত দিবে। তা হলে শয়তান তার কখনো ক্ষতি করবে না।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)আলী (আ.)-কে সম্বোধন করে আরো বলেছেন: হে আলী! আমি কি তোমাকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে অবগত করবো না? বললাম: অবশ্যই, হে রাসূলুল্লাহ্! তিনি বললেন: সে হলো সেই ব্যক্তি যে (অন্যের) পাপকে ক্ষমা করে না এবং বিচ্যুতিকে মেনে নেয় না। আমি কি তার চেয়েও অধম ব্যক্তির সংবাদ তোমাকে দেব? বললাম: অবশ্যই, হে রাসূলুল্লাহ্! তিনি বললেন : সে হলো সেই ব্যক্তি যার অনিষ্টতা থেকে পরিত্রাণ নেই, আর যার থেকে কল্যাণেরও কোনো আশা নেই।

হে আলী! সত্যিই আল্লাহ্ খুশী হন তাঁর বান্দার ওপর যখন সে বলে : হে প্রতিপালক আমার! আমাকে ক্ষমা করো। তুমি ছাড়া পাপ মার্জনা করার আর কেউ নেই। আল্লাহ্ বলেন : হে আমার ফেরেশতারা! আমার এ বান্দা জেনেছে যে, আমি ছাড়া পাপ মার্জনা করার কেউ নেই। তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাকে মার্জনা করে দিলাম।

হে আলী! মিথ্যা পরিহার করো। কারণ, মিথ্যা মুখে কালিমা এনে দেয়, আর সে আল্লাহর কাছে মিথ্যুক হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। আর সত্য মুখ উজ্জ্বল করে আর আল্লাহর কাছে সত্যবাদী বলে লিপিবদ্ধ হয়। জেনে রাখ, সত্য হলো কল্যাণময়, আর মিথ্যা অমঙ্গলকর।

হে আলী! পরনিন্দা ও একের কথা অপরের কাছে লাগানো থেকে দূরে থাক। কারণ, পরনিন্দা রোযাকে বিনষ্ট করে আর কথা লাগানো কবর আযাবের কারণ হয়।#

হে আলী! আগামীকালের জীবিকা নিয়ে দুঃখ করো না। কারণ, প্রত্যেক আগামীকালের (সাথে তার জন্য নির্ধারিত) জীবিকাও এসে পড়ে।

হে আলী! গোঁয়ার্তুমি থেকে দূরে থাক। এর গোড়ায় রয়েছে মূর্খতা আর পরিণামে রয়েছে অনুশোচনা।

হে আলী! দাঁত মাজতে ভুলো না। কারণ, দাঁত মাজার ফলে মুখ পবিত্র হয়, আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হন এবং চোখের জ্যোতি বাড়ে। আর দাঁত খিলাল করার কারণে তুমি ফেরেশতাদের প্রিয় হবে। কারণ, যে ব্যক্তি খাওয়ার পর দাঁত খিলাল করে না তার মুখের দুর্গন্ধে ফেরেশতারা বিরক্ত হয়।

হে আলী! রাগান্বিত হয়ো না। আর যদি রাগান্বিত হও, তা হলে বসে পড় এবং আল্লাহর বান্দাদের ওপর তাঁর ক্ষমতার কথা এবং তাদের প্রতি তাঁর ধৈর্যের কথা চিন্তা করো। আর যখন তোমাকে বলা হয় : আল্লাহকে ভয় করো, তখন তোমার ক্রোধকে দূরে ঠেলে দাও এবং ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় প্রত্যাবর্তন করো।

হে আলী! তোমার নিজের জন্য যা কিছু ব্যয় করো তার মধ্যে আল্লাহকে (সন্তুষ্টিকে) উদ্দেশ্য করো। যাতে আল্লাহর কাছে তোমার জন্য সঞ্চয় হয়।

হে আলী! নিজ পরিবার, প্রতিবেশী এবং যাদের সাথে ওঠা-বসা ও কথাবার্তা বল তাদের সাথে সদাচরণ করবে যাতে আল্লাহর কাছে সেগুলো সঞ্চিত দেখতে পাও।

হে আলী! যা কিছু নিজের জন্য পছন্দ করো না, তা অন্যের জন্যও কামনা করো না। আর যা কিছু নিজের জন্য পছন্দ করো, তা তোমার ভাইয়ের জন্যও চাও। যাতে তোমার বিচারে ন্যায়বান হতে পার এবং তোমার ন্যায়বিচারে সুবিচারক হতে পার, আর আসমানবাসীর কাছে প্রিয় হতে পার, আর জমিনবাসীর বুকে বন্ধুর আসন করে নিতে পার। আমার এ ওসিয়তকে সংরক্ষণ করো মহান আল্লাহ্ চাহেন তো।

এবারে শামউন ইবনে লাভী ইবনে ইয়াহুদা নামক একজন পাদ্রীর নানা প্রশ্নের জবাবে বিশ্বনবী (সা.) যেসব অমূল্য বক্তব্য রেখেছিলেন সেগুলোর কিছু প্রধান অংশ এখানে তুলে ধরব। শামউন ঈসা (আ.)-এর জনৈক হাওয়ারীর বংশধর ছিলেন। তিনি মহানবী (সা.) এর কাছে অনেক প্রশ্ন তুলে ধরেন। আর রাসূল (সা.) তার সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন। ফলে শামউন তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং তাঁর নবুওয়াতকে সত্য বলে স্বীকার করে নেন।

এক পর্যায়ে শামউন বলেন : আমাকে বলুন দেখি আকল তথা বুদ্ধিবৃত্তি কি এবং তার প্রকৃতি কিরূপ? তা থেকে কি নির্গত হয় এবং কী নির্গত হয় না? সেগুলোর সব শ্রেণীর ব্যাখ্যা দিন। রাসূলে খোদা (সা.) বললেন :

“আকল হলো অজ্ঞতা এবং নাফসের একটি বাঁধন। নাফস (প্রবৃত্তি) জঘন্যতম জন্তুর ন্যায়। যদি এ বাঁধন না থাকে, তা হলে তা পাগলা কুকুর হয়ে যায়। সুতরাং আকল হলো অজ্ঞতার বাঁধন। আল্লাহ্ আকলকে সৃষ্টি করলেন এবং তাঁকে বললেন : সামনে ফেরো। সে ফিরলো। তাকে বললেন : পেছনে ফেরো। সেও পেছনে ফিরলো। আল্লাহ্ বললেন : আমার মহিমা ও মর্যাদার শপথ, তোমার চেয়ে বড় এবং অধিক অনুগত কোনো সৃষ্টিকে আমি সৃষ্টি করি নি। তোমাকে দিয়েই শুরু করবো এবং তোমাকেই নিজ দরগাহে ফিরিয়ে আনব। পারিশ্রমিক এবং সওয়াব তোমার জন্যই। শাস্তিও তোমার ভিত্তিতেই হবে। আকল থেকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা নির্গত হলো। আর ধৈর্য থেকে জ্ঞান। আর জ্ঞান থেকে চিন্তার পরিপক্কতা, আর চিন্তার পরিপক্কতা থেকে চারিত্রিক পবিত্রতা। আর চারিত্রিক পবিত্রতা থেকে আত্মসংযম। আর আত্মসংযম থেকে লজ্জা। আর লজ্জা থেকে ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্ততা, আর ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্ততা থেকে অব্যাহতভাবে সৎ কাজে প্রবৃত্ত হওয়া। আর অব্যাহতভাবে সৎ কাজে প্রবৃত্ত হওয়া থেকে মন্দ কাজকে ঘৃণা করা। আর মন্দ কাজকে ঘৃণা করা থেকে উপদেশ দাতার উপদেশ মেনে চলা। এ হলো কল্যাণের দশটি শ্রেণী। এ প্রত্যেক শ্রেণীর আবার দশটি করে প্রকার রয়েছে।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলছিলেন, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা থেকে (আসে) : ১. সুন্দর বৈশিষ্ট্যে সজ্জিত হওয়া ২. পুণ্যবানদের সাথে ওঠাবসা ৩. লাঞ্ছনা দূরীকরণ ৪. নিচতা থেকে নির্গমন, ৫। কল্যাণের প্রতি ঝোঁক, ৬. উচ্চতর মর্যাদার নিকটবর্তী হওয়া, ৭. মার্জনা ৮. অবকাশ প্রদান, ৯. সদাচার, ১০. নীরবতা। বুদ্ধিমান ব্যক্তির সহিষ্ণুতা থেকে এসব নির্গত হয়।

আর জ্ঞান থেকে নির্গত হয় : ১. অভাবহীনতা, এমনকি যদি নিঃস্বও হয়ে থাকে। ২. দানশীলতা, যদিও সে কৃপণ থাকে। ৩. ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি, যদিও সে বিনয়ী থাকে, ৪। সুস্থতা, যদিও সে রুগ্ন থাকে, ৫. নৈকট্য, যদিও সে দূরে থাকে, ৬. লজ্জাশীলতা, যদিও সে মুখরা থাকে, ৭. মর্যাদাশীলতা, যদিও সে অধীনস্থ হয়, ৮. আভিজাত্য, যদিও সে নীচ (বংশের হয়ে) থাকে, ৯. প্রজ্ঞা এবং ১০. (যোগ্যতা, সুযোগ-সুবিধা ও সময়ের) সদ্ব্যবহার। এগুলো হলো আকল-সমৃদ্ধ বা বিবেকবান ব্যক্তির জ্ঞানের ফল। সুতরাং ধন্য হোক সে ব্যক্তি যে আকলকে প্রয়োগ করেছে এবং জ্ঞান লাভ করেছে।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলছিলেন, আর চিন্তার পরিপক্কতা থেকে নির্গত হয় : ১. অবিচলতা, ২. হেদায়েত, ৩. সৎকর্মশীলতা ৪. সংযমশীলতা, ৫. সফলতা, ৬. মধ্যপন্থা, ৭. মিতাচার, ৮. পারিশ্রমিক ও সওয়াব ৯. মর্যাদা ১০. আল্লাহর দীনকে অনুধাবন। এগুলো বিবেকবান ব্যক্তি তার চিন্তার পরিপক্কতা থেকে লাভ করে। ধন্য হোক সেই ব্যক্তি যে সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে চলে।

আর চারিত্রিক পবিত্রতা থেকে যা যা উৎসারিত হয় সেগুলো হল : ১. সন্তুষ্টি, ২. প্রশান্তি৩. উপকার লাভ, ৪. শান্তি, ৫. যাচাই (সতর্ক অনুসন্ধান), ৬. বিনয়, ৭. (আল্লাহর) স্মরণ, ৮, চিন্তা-গবেষণা, ৯, বদান্যতা, ১০. উদারতা।

এগুলো বিবেকবান ব্যক্তির চারিত্রিক পবিত্রতা থেকে উৎসারিত হয় আর সে আল্লাহর প্রতি ও নিজের ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে।

আর আত্মসংযম থেকে যা যা উৎসারিত হয় সেগুলো হল : ১. কল্যাণ চিন্তা, ২. বিনয়, ৩. সংযম ৪. তওবা, ৫. বোধশক্তি, ৬. শিষ্টাচার, ৭. সদাচার ৮. বন্ধুত্ব, ৯. কল্যাণকর এবং ১০. সুআচার-ব্যবহার। এগুলো বিবেকবান ব্যক্তি তার সম্ভ্রম থেকে লাভ করে। ধন্য সেই ব্যক্তি যার প্রভু তাকে আত্মসংযমের বৈশিষ্ট্য দিয়ে সম্মানিত করেন।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলছিলেন, আর লজ্জা থেকে উৎসারিত হয় : ১. নমনীয়তা, ২. দয়াশীলতা, ৩ ও ৪. প্রকাশ্যে এবং গোপনে আল্লাহর পাহারার প্রতি মনোযোগ, ৫. (দৈহিক ও মানসিক) সুস্থতা, ৬, মন্দ থেকে দূরে থাকা, ৭. সমৃদ্ধি, ৮. দানশীলতা, ৯. বিজয় এবং ১০. মানুষের মাঝে সুনামের সাথে স্মরণ। এগুলো বিবেকবান ব্যক্তি তার লজ্জা থেকে অর্জন করে। সুতরাং ধন্য সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর নসিহত গ্রহণ করে এবং তাঁর অপমানকে ভয় করে।

আর ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্ততা থেকে উৎসারিত হয় : ১. দয়া, ২. পরিণামদর্শিতা, ৩. আমানত রক্ষা, ৪. খেয়ানত বর্জন, ৫. সত্যবাদিতা, ৬. লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা, ৭. সম্পদের পরিশুদ্ধি, ৮. শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি, ৯. অসঙ্গত কাজ থেকে নিষেধ, ১০. বোকামি বর্জন। বিবেকবানরা এসব বিষয় ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্ততা থেকে পেয়ে থাকেন। সুতরাং ধন্য সেই ব্যক্তি যে ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্তের অধিকারী হয় এবং যার মধ্যে লঘুচিত্ততা আর মূর্খতা থাকে না এবং যে ক্ষমাশীল হয় ও মার্জনা করে।

আর বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলের অন্যতম কল্যাণ ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্ততা থেকে উৎসারিত হয় (সংখ্যাগুলো কথায় বলুন) : ১. দয়া, ২. পরিণামদর্শিতা, ৩. আমানত রক্ষা, ৪. খেয়ানত বর্জন, ৫. সত্যবাদিতা, ৬. লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষা, ৭. সম্পদের পরিশুদ্ধি, ৮. শত্রুর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি, ৯. অসঙ্গত কাজ করতে নিষেধ করা, ১০. বোকামি বর্জন। বিবেকবানরা এসব বিষয় ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্ততা থেকে পেয়ে থাকেন। সুতরাং ধন্য সেই ব্যক্তি যে ব্যক্তিত্ব ও স্থিরচিত্তের অধিকারী হয় এবং যার মধ্যে লঘুচিত্ততা আর মূর্খতা থাকে না এবং যে ক্ষমাশীল হয় ও মার্জনা করে।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলছিলেন, আর বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলের অন্যতম কল্যাণ অব্যাহতভাবে সৎ কাজে প্রবৃত্ত হওয়া থেকে লাভ হয় : ১. অশ্লীল কথাবার্তা বর্জন, ২. মনের উৎকণ্ঠা থেকে দূরে থাকা, ৩. সতর্কতা অবলম্বন ৪. ইয়াকীন তথা অবিচল বিশ্বাস, ৫. মুক্তি-প্রিয়তা, ৬. আল্লাহর আনুগত্য, ৭. কুরআনের প্রতি সম্মান, ৮. শয়তান থেকে দূরে সরে যাওয়া, ৯. ন্যায়কে মেনে নেয়া এবং ১০. হক ও ন্যায্য কথা। এগুলো বিবেকবান ব্যক্তি ভালো কাজে অবিচ্ছিন্নভাবে সৎ কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার ফলে লাভ করে থাকে। ধন্য সেই ব্যক্তি যে নিজ ভবিষ্যতের চিন্তায় এবং নিজ পরকালের চিন্তায় থাকে। আর দুনিয়ার ধ্বংস থেকে শিক্ষা নেয়।

আর বুদ্ধিবৃত্তি বা আকলের অন্যতম কল্যাণ মন্দকে ঘৃণা করা থেকে লাভ হয় : ১. ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা, ২. সহিষ্ণুতা, ৩. উপকার করা, ৪. পরিকল্পনার ওপর স্থির থাকা, ৫. সঠিক পথকে আগলে রাখা, ৬. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, ৭. প্রাচুর্য, ৮. নিষ্ঠা, ৯. সব অনর্থক কাজ বর্জন এবং ১০. যা কিছু তার জন্য উপকারী তা বজায় রাখা। এগুলো বিবেকবানেরা মন্দকে ঘৃণার মাধ্যমে অর্জন করে থাকেন। সুতরাং ধন্য সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর হক পথে পদক্ষেপ নেয়, আর তাঁর পথেই চলে।

বিশ্বনবী (সা.)শামউনের প্রশ্নের জবাবে আরো বলছিলেন, বুদ্ধিবৃত্তির অন্যতম কল্যাণ হিসেবে উপদেশদাতার অনুসরণ থেকে লাভ হয় : ১. বুদ্ধির বিকাশ, ২. আত্মিক পূর্ণতা সাধন, ৩. ভালো পরিণাম, ৪. ভর্ৎসনার হাত থেকে মুক্তি, ৫. গ্রহণীয় হওয়া, ৬. বন্ধুত্ব, ৭. অন্তরের প্রসারতা, ৮. ন্যায়বিচার বা ইনসাফ, ৯. কাজে-কর্মে উন্নতি, এবং ১০. আল্লাহর আনুগত্যের শক্তি সঞ্চার। ধন্য সেই ব্যক্তি যে নাফসের দ্বারা পরাস্ত হওয়া থেকে নিরাপদ থাকে। এগুলো হলো সেই বৈশিষ্ট্য যা আকল থেকে উৎপত্তি লাভ করে।

এ পর্যায়ে শামউন বিশ্বনবী (সা.)-কে বলেন : মূর্খদের চি‎হ্নগুলো আমাকে বলুন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন : যদি তার সাথে তথা মূর্খের সঙ্গে মেশ, সে তোমাকে কষ্ট দেবে। যদি তার থেকে দূরে সরে যাও, তোমার বদনাম করবে। যদি তোমাকে দান করে, তাহলে তোমার ওপর করুণার গর্ব করবে। আর তুমি যদি তাকে দান করো, তা হলে অকৃতজ্ঞ হবে। যদি কোনো গোপন কথা তার সাথে বল, সে খেয়ানত করবে। আর তোমাকে যদি কোনো গোপন কথা সোপর্দ করে, তা হলে তোমার প্রতি অভিযোগ করবে। মূর্খ যদি ক্ষমতাবান হয়, তা হলে অরাজকতা করে এবং রূঢ় ও নিষ্ঠুর হয়। যদি নিঃস্ব হয়, তা হলে আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করে। যদি আনন্দিত হয় তা হলে সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং অবাধ্য হয়, আর যদি দুঃখিত হয়, তা হলে নিরাশ হয়ে পড়ে। মূর্খ যদি হাসে তা হলে অট্টহাসি দেয়, আর যদি কাঁদে, তা হলে পশুর মতো গর্জন করে। মূর্খ ব্যক্তি সৎ লোকদের সাথে ঝগড়া করে। আল্লাহকে ভালোবাসে না এবং তাঁকে মান্য করে না। তাঁর থেকে লজ্জা করে না এবং তাঁকে স্মরণ করে না। তুমি যদি তাকে খুশী করো, তা হলে তোমার এমন গুণের প্রশংসা করবে যা তোমার মধ্যে নেই। আর যদি তোমার ওপর অসন্তুষ্ট হয় , তা হলে তোমার প্রশংসাকে বিনষ্ট করে। আর মিথ্যা প্রচারে তোমার বদনাম ছড়ায়। এগুলো মূর্খদের পন্থা।

এরপর পাদ্রি শামউন রাসূল (সা.)কে প্রশ্ন করেন, ইসলামের নিদর্শন কী, আমাকে বলুন।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন : বিশ্বাস, জ্ঞান এবং কর্ম।

পাদ্রি শামউন প্রশ্ন করেন : ঈমানের , জ্ঞানের ও কর্মের চি‎হ্ন কী?

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন : ঈমানের চি‎হ্ন চারটি : আল্লাহর একত্বের স্বীকারোক্তি, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস আর তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস।

আর জ্ঞানের চি‎হ্ন চারটি : আল্লাহকে চেনা, তাঁর বন্ধুদের পরিচয় জানা, তাঁর ফরযগুলোকে জানা এবং সেগুলোর সংরক্ষণ করা যাতে সেসব সঠিকভাবে সম্পাদিত হয়।

আর কর্মের চি‎হ্ন হলো নামায, রোযা, যাকাত এবং নিষ্ঠা তথা ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা।

এক পর্যায়ে তিনি রাসূল (সা.)-কে বলেন: আমাকে সংবাদ দিন সত্যবাদী, মুমিন, ধৈর্যশীল, তওবাকারী, কৃতজ্ঞ, বিনয়ী, সৎকর্মশীল, উপদেশদাতা, ইয়াকীন বা বদ্ধমূল বিশ্বাসের অধিকারী, নিষ্ঠাবান, দুনিয়াত্যাগী, পুণ্যবান, পরহিজগার, জাহিরকারী, অত্যাচারী, লোক দেখানো আমলকারী, মুনাফিক, হিংসুক, অপচয়কারী, গাফেল লোক, বিশ্বাসঘাতক, অলস, মিথ্যুক এবং ফাসিকের চি‎হ্নগুলো কী কী?

তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন : সত্যবাদীর চি‎হ্ন চারটি : ১. নিজে সত্য কথা বলে, ২. আল্লাহর পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি এবং শাস্তির অঙ্গীকারগুলোকে সত্য বলে জানে, ৩. নিজের করা ওয়াদা বা অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং ৪. প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করে না।

আর মুমিনের চি‎হ্ন হলো, সে দয়াশীল হয়, অনুধাবন করে এবং লজ্জাশীল হয়।

আর ধৈর্যশীলের চি‎হ্ন চারটি : ১. অপছন্দনীয় বিষয়ে ধৈর্যধারণ, ২. ভালো কাজের সংকল্প, ৩. বিনয় এবং ৪. সহিষ্ণুতা।

বিশ্বনবী (সা.)শামউনের প্রশ্নের জবাবে আরো বলেন, আর তওবাকারীর চি‎হ্ন চারটি : ১. শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা, ২. মিথ্যা বা বাতিলকে ত্যাগ করা, ৩. সত্যের ওপর অবিচল থাকা এবং ৪. ভালো কাজের প্রতি লোভ বা গভীর আগ্রহ।

আর কৃতজ্ঞের চি‎হ্ন চারটি : ১. নেয়ামতগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা, ২. বিপদের জন্যেও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, ৩. আল্লাহর বরাদ্দে তুষ্ট থাকা, ৪. আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের প্রশংসা ও মহিমা জ্ঞাপন না করা।

আর বিনয়ীর চি‎হ্ন চারটি : ১. প্রকাশ্যে এবং গোপনে আল্লাহকে ভয় করা, ২. ভালো ও সুন্দর ধারণা করা, ৩. পরকালের চিন্তা ও ৪. আল্লাহর কাছে মোনাজাত।

সৎকর্মশীলের চি‎হ্ন চারটি : ১. নিজ অন্তরকে পবিত্র করবে ২. তার কাজকে ভালো করবে, ৩. উপার্জনকে পরিশুদ্ধ করবে এবং ৪. তার সকল বিষয়কে সঠিকভাবে সম্পাদন করবে।

উপদেশদাতার চি‎হ্ন চারটি : ১. ন্যায়-বিচার করবে, ২. নিজের পক্ষ থেকে অন্যদের অধিকার প্রদান করবে, ৩. মানুষের জন্য সেটাই পছন্দ করবে যা নিজের জন্য পছন্দ করবে, ৪. কারো প্রতি সীমা অতিক্রম করবে না।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেন, বদ্ধমূল ধর্ম-বিশ্বাস বা ইয়াকীনের অধিকারীর চি‎হ্ন ছয়টি : ১. আল্লাহর অস্তিত্বের বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন এবং এর ভিত্তিতেই তাঁর প্রতি ঈমান আনা ২. ইয়াকীন রাখা যে, মৃত্যু নিশ্চিত এবং এ বিষয়ে সতর্ক থাকা। ৩. ইয়াকীন রাখা যে, কিয়ামত সত্য এবং সেদিনের লাঞ্ছনাকে ভয় করা, ৪. ইয়াকীন রাখা যে, বেহেশত সত্য ও এতে আসক্ত থাকা, ৫. ইয়াকীন রাখা যে, জাহান্নাম সত্য এবং তা থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা, এবং ৬. ইয়াকীন রাখা যে, হিসাব-নিকাশ সত্য, কাজেই নিজেই নিজের হিসাব-নিকাশ করা।

নিষ্ঠাবানের নিদর্শন চারটি : ১. তার অন্তর বিশুদ্ধ, ২. তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাপাচার থেকে বিরত থাকে, ৩. তার মঙ্গল বা সেবা অন্যরা লাভ করে, ৪. অন্যরা তার অনিষ্ট থেকে মুক্ত থাকে।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেন, দুনিয়াত্যাগীর চি‎হ্ন দশটি : ১. হারামগুলোর প্রতি নিষ্পৃহ, ২. নিজ প্রবৃত্তিকে সংযত রাখে, ৩. তার প্রতিপালকের তথা আল্লাহর নির্ধারিত ফরজগুলো পালন করে, ৪. যদি ক্রীতদাস হয়, তা হলে সে মালিকের অনুগত থাকে, আর যদি মালিক হয়, তা হলে ভালো একজন মনিব, ৫. গোঁড়া ও বর্ণবাদী নয়, ৬. বিদ্বেষী নয়, ৭. খারাপ আচরণকারীর সঙ্গে ভালো বা সুন্দর আচরণ করে, ৮. যে তার ক্ষতি করে, তার সে কল্যাণ করে, ৯. তার ওপর যে অত্যাচার করে, তাকে ক্ষমা করে, এবং ১০. আল্লাহর অধিকার পালনে বিনত থাকে।

পুণ্যবানের চি‎হ্ন দশটি : ১. আল্লাহর জন্য ভালোবাসে, ২. আল্লাহর জন্য শত্রুতা করে, ৩. আল্লাহর জন্য কারো সহযোগী হয়, ৪. আল্লাহর জন্য কারো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, ৫. আল্লাহর জন্য রাগান্বিত হয়, ৬. আল্লাহর জন্য খুশী হয়, ৭. আল্লাহর জন্য কাজ করে, ৮. আল্লাহর সন্ধান করে, ৯. আল্লাহর প্রতি বিনয়ী থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়, পবিত্র, নিষ্ঠাবান, লজ্জিত ও সতর্ক এবং ১০. আল্লাহর জন্য সদাচার করে।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেন, পরহিজগারের চি‎হ্ন ছয়টি : ১. আল্লাহকে ভয় করে, ২. তাঁর ক্রোধ সম্পর্কে সতর্ক থাকে, ৩ ও ৪. সকাল-সন্ধ্যা এমনভাবে অতিবাহিত করে যেন আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখছে, ৫. দুনিয়াকে গুরুত্ব দেয় না, ৬. দুনিয়ার কোনো কিছুই তার কাছে বড় নয়, যদিও ওইসব বিষয় বা বস্তুর বৈশিষ্ট্য অথবা আচরণ মোহনীয় বা চাকচিক্যময় হয়ে থাকে।

জাহিরকারীর চি‎হ্ন চারটি : ১. অনর্থক ঝগড়া বা তর্ক করে, ২. তার ঊর্ধ্বনতনদের সাথে ঝগড়া করে, ৩. যা কিছু লাভ করতে পারে না তার পেছনেই ছুটে, ৪. যা কিছু তাকে মুক্তি দেয় না তার পেছনেই সকল চেষ্টা চালায়।

অত্যাচারীর চি‎হ্ন চারটি : ১. তার ঊর্ধ্বতনের প্রতি অবাধ্যতাবশত অত্যাচার করে, ২. তার অধস্তন বা অধীনস্থদের ওপর চড়াও হয়, ৩. সত্য ও ন্যায়ের সঙ্গে শত্রুতা করে, ৪. প্রকাশ্যে অত্যাচার করে।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেন, লোক দেখানো আমলকারীর চি‎হ্ন চারটি : ১. অন্যদের সামনে অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হয়, ২. নির্জনে অলসতা করে, ৩. প্রত্যেক কাজেই প্রশংসার প্রত্যাশী, ৪. বাহ্যিকভাবে নিজেকে ভাল দেখাতে তৎপর।

মুনাফিকের চি‎হ্ন চারটি : ১. তার স্বভাব নষ্ট, ২. তার জিহ্বা তথা মুখের কথা তার অন্তরের বিপরীত, ৩. তার কথা এবং কাজ আলাদা, ৪. তার গোপন অবস্থা আর প্রকাশ্য অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন। মুনাফিক! জাহান্নামের আগুন থেকে অসহায় বা হতভাগ্য।

আর হিংসুকের চি‎হ্ন চারটি : ১. পরনিন্দা, ২. তোষামোদি, ৩. বিপদে গালি-গালাজ (মূল সূত্রেই চতুর্থটি বাদ পড়েছে)।

সীমালঙ্ঘনকারীর চি‎হ্ন চারটি : ১. বাতিল বিষয়ে গর্ব করে, ২. তার উপযুক্ত নয় এমন খাদ্য আহার করে, ৩. ভালো কাজের প্রতি নিষ্পৃহ, ৪. যার থেকে সে কোন কল্যাণ লাভ করতে পারেনি তাকে অস্বীকার করে।

উদাসীন লোকের চি‎হ্ন চারটি : ১. অন্ধত্ব, ২. ভুল, ৩. অহেতুক কাজ, ৪. বিস্মৃতি।#

অলস লোকের চি‎হ্ন চারটি : ১. এতটা আলসেমি করে যে অবহেলায় পর্যবসিত হয়, ২. এতটা অবহেলা করে যে (সুযোগ) হাতছাড়া করে, ৩. যখন (সুযোগ) হাতছাড়া করে তখন তা পাপ বলে গণ্য হয়, ৪. আর পাপের কারণে কষ্ট অনুভব করে।

মিথ্যুকের চি‎হ্ন চারটি : ১. কখনও কথা বললে মিথ্যা বলে, ২. যদি তাকে কিছু বলা হয় বিশ্বাস করে না, ৩. একের কথা অন্যের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়, ৪. মিথ্যারোপ করে।

ফাসিকের চি‎হ্ন চারটি : ১. অর্থহীন কাজ করে, ২. বেহুদা কথা বলে, ৩. সীমা অতিক্রম করে, ৪. মিথ্যারোপ করে।

বিশ্বাসঘাতকের চি‎হ্ন চারটি : ১. আল্লাহর নির্দেশকে অমান্য করা, ২. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া, ৩. সহকর্মীদের ঘৃণা করা এবং ৪. অবাধ্যদের সাথে ঘনিষ্ঠতা।

এরপর শামউন বিশ্বনবী (সা.)-কে বললেন : আপনি আমাকে নিরাময় দিলেন এবং আমার অন্ধত্ব ঘুচিয়ে দৃষ্টিবান করে তুললেন। অনুগ্রহ করে আমাকে এমন কিছু পন্থা শিখিয়ে দিন যা দিয়ে আমি পথ চলতে পারি।

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন : হে শামউন! সত্য কথা হলো তোমার কিছু শত্রু রয়েছে যারা তোমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং তোমার দীনকে কেড়ে নিতে চায়। তারা জিন এবং মানুষ থেকে। মানুষের মধ্যে তোমার শত্রু হলো যারা পরকালের ভাবনায় থাকে না এবং আল্লাহর কাছে যা রয়েছে সেদিকে কোনো আকর্ষণ নেই। তাদের চেষ্টা শুধু মানুষকে তাদের কাজের জন্য তিরস্কার করবে এবং ছিদ্রান্বেষণ করবে, তবে নিজের কাজের জন্য কখনই নিজেকে তিরস্কার করবে না। যদি তোমাকে দেখে সত, তা হলে হিংসা করবে এবং বলবে : লোক দেখানো কাজ। আর যদি তোমাকে দেখে খারাপ তখন বলে: তার মধ্যে ভালো কিছুই নেই।

আর জিনদের মধ্যে তোমার শত্রু হলো ইবলিস এবং তার সেনাদল। যখন তোমার কাছে আসে, বলে, তোমার পুত্র মারা গেছে। তখন তুমি বলবে, সকল জীবই সৃষ্টি হয়েছে মৃত্যুবরণ করার জন্য। আর আমার কলিজার টুকরো বেহেশতবাসী হয়েছে যা আমার জন্য খুশীর কারণ।

আর যখন সে তোমার কাছে এসে বলবে : তোমার মাল-সম্পদ চলে গেছে, তখন বলবে : সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি দান করেছেন এবং তুলে নিয়েছেন। আর আমাকে যাকাত থেকে মুক্ত করেছেন। এখন আমার ওপর কোনো যাকাত রইলো না। আর যখন তোমার কাছে এসে বলবে : লোকে তোমার ওপর অত্যাচার করে অথচ তুমি অত্যাচার করো না। তখন বলবে : নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন বিচার তাদেরই হবে যারা লোকজনের ওপর অত্যাচার করে। আর পুণ্যবানদের বিচার নেই। আর যখন তারা তোমার কাছে এসে বলবে : তুমি কত বেশি সদাচারী! এর মাধ্যমে সে চায় তোমার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করতে। তখন বলবে : আমার মন্দকর্ম আমার সদাচারের চেয়ে বেশি। আর যখন তোমার কাছে এসে বলবে : তোমার নামায কত বেশি! তখন বলবে : আমার গাফিলতি আমার নামাযের চেয়ে বেশি। আর যখন এসে বলবে : তুমি মানুষকে কত দান করো! তখন বলবে : তাদের কাছ থেকে যা গ্রহণ করি, তা আমি যা তাদেরকে দান করি, তার চেয়ে বেশি। আর যখন তোমার কাছে এসে বলবে : তোমার ওপর কত বেশি অত্যাচার করে তখন তুমি বলবে : আমি যাদেরকে অত্যাচার করেছি তারা আরো বেশি। আর যখন তোমাকে এসে বলবে : তুমি কত বেশি কাজ করো। তখন বলবে : এর চেয়ে অধিক আমি অবাধ্যতা করেছি। আর যখন তোমার কাছে এসে বলবে : মদপান করো। তখন বলবে : আমি পাপ করব না। আর যখন এসে তোমাকে বলবে : দুনিয়াকে কি ভালোবাস না? তখন বলবে: আমি তাকে ভালোবাসি না, যে অন্যদেরকে ধোঁকা দিয়েছে।

হে শামউন! পুণ্যবানদের সাথে চলাফেরা করো এবং নবীদের অনুসরণ করো : ইয়াকুব, ইউসূফ এবং দাউদ। নিশ্চয় আল্লাহ্ যখন ভূনিম্নস্থ সাগরকে সৃষ্টি করলেন, তখন সে গর্বে উথলে উঠে বলল, কি আছে আমার ওপর প্রবল হবে? তখন জমিনকে সৃষ্টি করলেন এবং তার পৃষ্ঠদেশ বিস্তৃত করলেন। ফলে অপদস্থ হলো। অতঃপর জমিন গর্ব করে বলল, কি আছে আমার ওপর প্রবল হবে? আল্লাহ্ পর্বতকে সৃষ্টি করলেন এবং পেরেকের ন্যায় তার পৃষ্ঠে গেঁথে দিলেন। যাতে সে নড়তে না পারে। ফলে জমিন অপদস্থ হলো এবং স্থির হয়ে গেল। অতঃপর পর্বতসমূহ জমিনের ওপর গর্ব করল। মাথা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বড়াই করে বলল : কি আছে আমার ওপর বিজয়ী হবে? আল্লাহ্ লোহাকে সৃষ্টি করলেন যাতে তাকে কাটতে পারে। ফলে পর্বত অপদস্থ হলো। অতঃপর লোহা পর্বতসমূহের ওপর গর্ব করল, বলল, কি আছে আমার ওপর বিজয়ী হবে? আল্লাহ্ আগুনকে সৃষ্টি করলেন এবং লোহাকে দগ্ধ করলেন। ফলে লোহা অপদস্থ হলো। অতঃপর আগুন শিখা ছড়ালো ও গর্জন তুলে নিজে নিজে গর্ব করল, বলল, কি আছে আমার ওপর বিজয়ী হয়? আল্লাহ্ পানিকে সৃষ্টি করলেন এবং আগুনকে নিভিয়ে দিলেন। আগুন অপদস্থ হলো। অতঃপর পানি নিজে নিজে গর্ব করল এবং ঢেউ ছড়ালো। বলল, কি আছে আমার ওপর বিজয়ী হয়? আল্লাহ্ বাতাসকে সৃষ্টি করলেন যাতে পানির ঢেউকে ধাক্কা দিল এবং তার অভ্যন্তরে যা ছিল উতরে দিল। আর তার প্রবাহ ধারা থেকে আটকে দিল। ফলে পানি অপদস্থ হলো। অতঃপর বাতাস নিজে নিজে গর্ব করল এবং ঘূর্ণিঝড়ের উদ্রেক করল। বলল, কি আছে আমার ওপর বিজয়ী হয়? আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করলেন। তারা অট্টালিকা নির্মাণ করল এবং ঝড়ের বিপরীতে আশ্রয় অন্বেষণ করল। বাতাস অপদস্থ হলো। অতঃপর মানুষ অবাধ্য হলো। বলল, কে আছে আমার ওপর বিজয়ী হয়? আল্লাহ্ মৃত্যুকে সৃষ্টি করলেন এবং মানুষকে তার অধীন করে দিলেন। মানুষও অপদস্থ হলো। অতঃপর মৃত্যুও নিজে নিজে অহংকার করল। আল্লাহ্ তাকে বললেন : নিজের ওপর অহংকার করো না। আমি তোমাকে বেহেশতী ও দোযখী দু’দলের মধ্যে জবাই করে দেব। আর কখনোই তোমাকে জীবিত করব না। তখন সে ভয় পেল। অতঃপর হুজুর (সা.) বললেন : রাগের ওপর ধৈর্য বিজয়ী আর ক্রোধের ওপর দয়া বিজয়ী। আর সাদাকাহ্ ভ্রান্তি ও বিচ্যুতিকে পরাস্ত করে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: হে মুআয! তাদেরকে তথা ইয়েমেনের নও-মুসলিমদেরকে আল্লাহর কুরআন শিক্ষা দাও। তাদেরকে ভালো চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তোল। মানুষকে তাদের নিজ নিজ স্থানে স্থাপন করো- সৎ হোক আর মন্দ হোক। আর আল্লাহর নির্দেশকে তাদের মধ্যে বাস্তবায়ন করো। আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর মালের ব্যাপারে কারো ভয় করবে না। কারণ, তা তোমার কর্তৃত্বাধীন বা ইখতিয়ারাধীন নয় এবং তোমার মালও নয়। আর তাদের আমানতকে কম হোক আর বেশি হোক তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে। আর অধিকার তরক করার ক্ষেত্র ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে তুমি তাদের সাথে নমনীয় ও ক্ষমাশীল হবে। মূর্খ বলবে, আল্লাহর অধিকার বর্জন করেছ। আর তোমার কর্মচারীদের পক্ষ থেকে যে বিষয়েই তোমার প্রতি অভিযোগের ভয় করবে, ক্ষমা চেয়ে নেবে যাতে তারা তোমাকে ক্ষমা করে। জাহেলি যুগের রীতি-নীতিগুলোর মূলোৎপাটন করবে, তবে সেগুলো ছাড়া যেগুলোকে ইসলাম সমর্থন করেছে।

বিশ্বনবী (সা.) মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-কে আরো বলেছেন, ইসলামের বিষয়গুলো তা ছোট-বড় যা-ই হোক সবগুলোকেই প্রকাশ করো। আর তোমার সর্বাধিক প্রচেষ্টা যেন নামাযের মধ্যে নিয়োজিত হয়। কেননা, নামায হলো ধর্মের প্রতি স্বীকারোক্তির পরে ইসলামের মূল বিষয়। মানুষকে আল্লাহ্ এবং পরকালের কথা স্মরণ করাও। উপদেশকে চালু রাখবে। কারণ, এটা আল্লাহর প্রিয় বিষয়গুলোর পথে চলতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর তাদের মধ্যে শিক্ষকদেরকে ছড়িয়ে দাও। আর ঐ আল্লাহর ইবাদত করো যার কাছে ফিরতে হবে। আর আল্লাহর রাস্তায় কারো ভর্তসনার তোয়াক্কা করবে না।

বিশ্বনবী (সা.) মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-কে আরো বলেছেন, আমি তোমাকে অসিয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করে চলবে, সত্য কথা বলবে, অঙ্গীকার রক্ষা করবে, আমানত ফিরিয়ে দেবে, খেয়ানত থেকে দূরে থাকবে, কোমল ভাষায় কথা বলবে, আগে সালাম দেবে, প্রতিবেশীকে সাহায্য করবে, অনাথের প্রতি সদয় হবে, ভালো কাজ করবে, প্রত্যাশাকে ছোট করবে, পরকালকে ভালোবাসবে, হিসাব-নিকাশকে ভয় করবে, ঈমানের প্রতি লেগে থাকবে, কোরআনকে বুঝে পড়বে, রাগ সংবরণ করবে এবং বিনয়ী হবে।
আমি তোমাকে সতর্ক করছি যে, কোন মুসলমান ভাইয়ের বদনাম করো না কিংবা পাপীকে অনুসরণ করো না কিংবা ন্যায়বান নেতাকে অমান্য করো না কিংবা সত্যবাদীকে অবিশ্বাস করো না, কিংবা মিথ্যাবাদীকে বিশ্বাস করো না। তোমার প্রতিপালককে পদে পদে স্মরণ করবে। আর প্রত্যেক পাপের জন্য নতুন করে তওবা করবে-গোপন পাপকে গোপন তওবার মাধ্যমে, আর প্রকাশ্য পাপকে প্রকাশ্য তওবার মাধ্যমে।

বিশ্বনবী (সা.) মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-কে আরো বলেছেন, হে মুআয! যদি না জানতাম যে, কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকব না, তা হলে আমার উপদেশকে ছোট করতাম। কিন্তু আমি জানি যে, আমরা কখনোই কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকব না। তাই জেনে রাখ, হে মুআয! তোমাদের মধ্যে আমার কাছে সেই বেশি প্রিয় যে আমার সাথে তদ্রূপ সাক্ষাৎ করবে যেরূপ (ভালো অবস্থায়?) আমার থেকে আলাদা হয়েছে।

এবারে বিশ্বনবী (সা.)’র অন্য একটি উপদেশমূলক ভাষণ বা বক্তব্য তুলে ধরছি:

প্রত্যেক জিনিসেরই মর্যাদা থাকে। আর সভার মর্যাদা হলো কিবলামুখী হওয়া। যে ব্যক্তি সবার চেয়ে প্রিয় হতে চায়, তার উচিত আল্লাহকে ভয় করা। যে ব্যক্তি চায় সবচেয়ে শক্তিশালী হতে, তার উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা করা। আর যে ব্যক্তি চায় সবচেয়ে ক্ষমতাবান হতে, তার উচিত নিজের কাছে যা আছে তার চেয়ে আল্লাহর কাছে যা আছে তার ওপর বেশি নির্ভর করা। এরপর মহানবী (সা.) বলেন : তোমাদেরকে কি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোকের কথা বলব? সবাই বলল : অবশ্যই হে রাসূলুল্লাহ্! তিনি বললেন :

যে ব্যক্তি একা বসবাস করে, আর আগন্তুককে বাধা দেয় ও নিজ ক্রীতদাসকে চাবুক মারে, তোমাদেরকে কি তার চেয়েও নিকৃষ্ট লোকের কথা বলব? সবাই বলল : অবশ্যই হে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)! তিনি বললেন : যে বিচ্যুতিকে ক্ষমা করে না এবং অজুহাতকে মেনে নেয় না। আবারো বললেন : তার চেয়েও নিকৃষ্ট লোকের কথা কি বলব না? সবাই বলল : অবশ্যই হে রাসূলুল্লাহ্ ! তিনি বললেন : যার কাছ থেকে ভালোর আশা নেই, আর যার অনিষ্টতা থেকেও নিস্তার নেই। এরপর বিশ্বনবী (সা.) বললেন : তার চেয়েও নিকৃষ্ট লোকের কথা কি তোমাদেরকে বলব না? সবাই বলল : অবশ্যই হে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)! তিনি বললেন : যে মানুষের সাথে শত্রুতা করে আর মানুষও তার সাথে শত্রুতা করে।

বিশ্বনবী (সা.)’র উপদেশমূলক ওই ভাষণে আরো এসেছে, “ঈসা (আ.) বনি ইসরাইলের উদ্দেশ্যে বলেছেন : হে বনি ইসরাইল! মূর্খের কাছে প্রজ্ঞার কথা বলো না, তা হলে তার ওপর অবিচার করবে। আর যারা প্রজ্ঞার পাত্র সেখানে তার থেকে কুণ্ঠিত হয়ো না, তা হলে তাদের ওপর অবিচার করবে। আর অত্যাচারীর সমকক্ষ হয়ো না, তা হলে তোমার গুণ-মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। হে বনি ইসরাইল! কাজকর্ম তিন ধরনের হয় :
এক ধরনের কাজের সঠিক হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। তোমরা তার পেছনেই থাকো। আরেক ধরনের কাজের ভ্রষ্ট হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। তোমরা তা পরিহার করো। আরেক ধরনের কাজ বিতর্কিত। সেটাকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দাও।

হে লোকেরা ! নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রয়েছে (কিছু) শিক্ষা। কাজেই সেসব শিক্ষার দিকে ফিরে যাও। আর নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রয়েছে পরিণতি। তোমরা সে পরিণতিতে পৌঁছাও। নিশ্চয়ই মুমিন ব্যক্তি দু’টি ভয়ের মধ্যে থাকে। প্রথমত সে জীবন নিয়ে যে জীবন তার পার হয়ে গেছে, অথচ জানে না সেজন্য আল্লাহ্ কী করবেন। আর দ্বিতীয়ত যে আয়ু তার বাকি রয়েছে, অথচ জানে না সেজন্য আল্লাহ্ কী নির্ধারণ করে রেখেছেন। কাজেই আল্লাহর বান্দাকে নিজের থেকেই নিজের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। দুনিয়াকে আখেরাতের জন্য, যৌবনকে বৃদ্ধ হওয়ার আগে এবং জীবনকে মৃত্যু আসার আগে কাজে লাগাতে হবে। সেই সত্তার (আল্লাহর) কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! মৃত্যুর পরে কোনো নালিশের জায়গা নেই। আর দুনিয়ার পরে কোনো বাড়ি নেই, বেহেশত এবং দোযখ ছাড়া।”

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন : জ্ঞান অর্জন করো। কারণ, তা শেখা ভালো। আর তা নিয়ে পরস্পর আলোচনা করা আল্লাহর তাসবিহ পাঠের সমতুল্য। আর জ্ঞান অনুসন্ধান করা হচ্ছে জিহাদের সমতুল্য। যে সে সম্পর্কে অবহিত নয় তাকে তা জানানো সদকাস্বরূপ। উপযুক্ত পাত্রে সেটা দান করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। কারণ, তা হারাম ও হালাল অবগত হওয়ার মাধ্যম হয়। আর যে ব্যক্তি জ্ঞান অনুসন্ধানে থাকে তা তাকে বেহেশতের দিকে পরিচালিত করে; তাকে একাকীত্বের ভয় থেকে রক্ষা করে ও নিঃসঙ্গতায় সঙ্গী হয়। আর জ্ঞান-অনুসন্ধান অজানা বা গোপন বিষয়ের নির্দেশক, শত্রুর বিরুদ্ধে হাতিয়ার এবং বন্ধুদের জন্য অলঙ্কার। আল্লাহ এর মাধ্যমে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটান ও তাদেরকে সত কাজের নেতা বানিয়ে দেন যাতে অন্যরা তাদের অনুসরণ করে এবং তাদের কাজ-কর্মের প্রতি অন্যরা মনোযোগী হয় ও তাদের নিদর্শনগুলো অন্যদের জন্য শিক্ষণীয় হয়। ফেরেশতারা তাদের সাথে বন্ধুত্বের জন্য প্রেমাকুল হয়ে পড়ে। কারণ, জ্ঞান হলো অন্তরগুলোর প্রাণ, দৃষ্টিগুলোর অন্ধত্ব দূরকারী আলো, শরীরগুলোর দুর্বলতা দূরকারী শক্তির মাধ্যম, আল্লাহ্ জ্ঞানের অধিকারীদেরকে বন্ধুর স্থানে আসীন করেন। আর দুনিয়া ও আখিরাতে তাদেরকে পুণ্যবানদের সাহচর্য দান করেন।

জ্ঞান সম্পর্কে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আরো বলেছেন,জ্ঞানের মাধ্যমেই আল্লাহর আনুগত্য হয় এবং তিনি উপাসিত হন। জ্ঞানের মাধ্যমেই আল্লাহ্ পরিচিত হন এবং একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা পায়। জ্ঞানই আত্মীয়তার বন্ধন জোড়া লাগায়, হালাল ও হারামকে চিনিয়ে দেয়। আর জ্ঞান হলো  বুদ্ধিমত্তা বা আকলের ইমাম  বা নেতা।

আল্লাহ্ সৌভাগ্যবানদেরকেই আকল তথা বুদ্ধি দান করেন। আর দুর্ভাগাদের তা থেকে বঞ্চিত করেন। বুদ্ধিমানদের বৈশিষ্ট্য হলো যে ব্যক্তি তার সঙ্গে মূর্খতা করে, তিনি তার প্রতি ধৈর্যশীল হন। আর যে ব্যক্তি তার ওপর জুলুম করে, তিনি তাকে ক্ষমা করেন।  বুদ্ধিমান তার অধীনদের প্রতি বিনয়ী হন। আর পুণ্য অর্জনের জন্য ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেন। যখন তিনি কথা বলতে চান, আগে ভেবে নেন। যদি পরিকল্পিত কথাটি ভালো মনে হয় তাহলেই বলেন এবং লাভবান হন। আর যদি পরিকল্পিত কথাটিকে মন্দ বলে মনে হয় তাহলে নীরব থাকেন এবং লাভবান হন। আর কোনো বিপদ নেমে আসলে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং নিজ হাত ও জিহ্বাকে সংবরণ করেন। আর যদি কোনো গুণ-মর্যাদা দেখতে পান সেটাকে লুফে নেন। লজ্জা তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না। তার থেকে কোনো লালসা প্রকাশ পায় না। এ হলো দশটি বৈশিষ্ট্য যা দিয়ে বুদ্ধিমানকে চেনা যায়।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন,আর মূর্খের বৈশিষ্ট্য হলো: সে যার সাথেই চলাফেরা করে, তার ওপর অবিচার করে। তার অধীনদের ওপর জুলুম করে। তার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে বেয়াদবি করে। তার কথা-বার্তা হয় চিন্তা ছাড়াই। যখন কথা বলে পাপ করে। আর যখন নিশ্চুপ থাকে, তখন উদাস হয়। যদি কোনো ফিতনার মুখোমুখি হয়, তা হলে সেদিকে ছুটে যায়। ফলে ফিতনা তাকে ধ্বংস করে দেয়। আর যদি কোনো গুণ-মর্যাদা প্রত্যক্ষ করে, মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ধীর গতি-সম্পন্ন হয়ে যায়। তার পুরাতন পাপগুলোকে ভয় পায় না। আর তার অবশিষ্ট ভালো কাজে আলস্য করে এবং শ্লথ হয়। আর যা কিছু সে নষ্ট করেছে অথবা তার হাতছাড়া হয়ে গেছে সেদিকে সে ভ্রুক্ষেপ করে না। এ হলো মূর্খের বা আকল থেকে বঞ্চিত ব্যক্তির দশটি বৈশিষ্ট্য।

এবারে বিশ্বনবী (সা.)’র একটি উপদেশ তুলে ধরছি:

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আরো বলেছেন, আমার কি হলো যে দেখছি দুনিয়া-প্রীতি অনেকের ওপর ভর করেছে? যেন মনে হয়, এ দুনিয়ায় মৃত্যু তাদের জন্য নয়, বরং অন্য কারো জন্য লেখা হয়েছে। যেন এ দুনিয়ার জবাবদিহি আল্লাহর কাছে অন্য কেউ করবে!  আর তাদের মৃতদের সংবাদকে এমন মুসাফির দলের সংবাদ বলে মনে করছে যারা শিগগিরই তাদের কাছে ফিরে আসবে! তাদের কবরে দাফন করে আর তাদের পরিত্যক্ত মাল-সম্পদকে ভক্ষণ করে। যেন তাদের জায়গায় সে নিজে চিরস্থায়ী থাকবে? হায় আফসোস, হায়! অনুজরা কি অগ্রজদের থেকে উপদেশ গ্রহণ করবে না? তারা আল্লাহর কিতাবে যে উপদেশই রয়েছে সেগুলোকে উপেক্ষা করে এবং ভুলে যায়। আর তারা প্রত্যেক মন্দ কাজের খারাপ পরিণতি থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করে। আর কোনো ক্ষয়-ক্ষতি নেমে আসার এবং কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটারও ভয় করে না।

ধন্য সেই ব্যক্তি যার  খোদা-ভীতি তাকে মানুষের ভয় থেকে বিরত রাখে, যার রোজগার পবিত্র, অন্তর পরিশুদ্ধ, বাহ্যিক দিকও সুন্দর এবং চরিত্র সঠিক।

ধন্য সেই ব্যক্তি যে তার সম্পদের অতিরিক্ত অংশ দান করে। আর বেশি কথা বলে না।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আরো বলেছেন, ধন্য সেই ব্যক্তি যে পবিত্র মহীয়ান আল্লাহর জন্য বিনত হয়। আর তার জন্য যা হালাল করা হয়েছে সেগুলোকেও ত্যাগ করে, অবশ্য আমার সুন্নাতকে বর্জন করার ইচ্ছা ছাড়া। আর দুনিয়ার ভালো ও আকর্ষণীয় জিনিসগুলোকেও পরিহার করে। অবশ্য আমার সুন্নাতকে ছেড়ে অন্য কোনো পন্থা গ্রহণ ছাড়া। আর আমার পরে আমার মনোনীত বংশধরদের সাথে থাকে এবং দীনের সমঝদার ও প্রজ্ঞাবানদের সাথে ওঠা-বসা করে। আর অভাবীদের দয়া করে। ধন্য সেই মুমিন ব্যক্তি যে আল্লাহর অবাধ্যতার পথ ছাড়া অন্য পথে তা ব্যয় করে। আর গরীব অসহায় লোকদের মাঝে তা বণ্টন করে দেয়। আর যারা গর্বিত ও অহংকারী হয়, দুনিয়ার প্রতি আসক্ত থাকে, বিদআত চালু করে এবং আমার সুন্নাতের বিরুদ্ধে চলে আর আমার পন্থার বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের থেকে দূরে থাকে। ধন্য সেই ব্যক্তি যে মানুষের সাথে সৎ আচরণ করে এবং তাদের উপকার করে, আর নিজ অনিষ্টতাকে তাদের থেকে ফিরিয়ে রাখে।

আল্লাহ্ যাকে পথ দেখান তাকে পথভ্রষ্ট করার কেউ নেই আর যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে পথ দেখানোর কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি এক-অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো অংশীদার নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মুহাম্মদ তাঁর বান্দা ও প্রেরিত পুরুষ।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমি তোমাদেরকে অসিয়ত করছি আল্লাহকে ভয় করার তথা তাকওয়ার প্রতি। তোমাদেরকে তাঁর নির্দেশ মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করছি। আর যা কিছু কল্যাণকর প্রথমেই আল্লাহর কাছে তা প্রার্থনা করছি। পরসমাচার, হে লোকেরা! আমি তোমাদের জন্য যা বর্ণনা করছি তা মনোযোগ দিয়ে শোনো। সত্যি কথা হলো আমি জানি না, হয়তো বা আগামী বছর এ স্থানে তোমাদের সাথে আমার আর সাক্ষাত হবে না।

বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে আরো বলেছেন: হে লোকেরা! তোমাদের রক্ত আর সম্ভ্রম তোমাদের ওপর হারাম যতক্ষণ না তোমাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হও। (অর্থাত মুসলমানের রক্তপাত ও সম্মান হানি করা নিষিদ্ধ) যেমনভাবে আজকের এ দিনে এ ভূখণ্ডে তথা পবিত্র মক্কায় তোমাদের ওপর তা হারাম। ওহে, আমি কি পৌঁছে দিয়েছি? হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থেকো।

যার কাছে কোনো কিছু আমানত রাখা হয় সে যেন ঐ আমানতকে আমানতদাতার কাছে ফিরিয়ে দেয়। নিশ্চয় জাহেলি যুগ থেকে কোনো টাকার সুদ কারো ওপর আরোপ হয়ে থাকলে (এখন) তা অকার্যকর হয়ে যাবে। আর সর্বপ্রথম যে সুদ বাতিল ( বা সুদ অকার্যকর করার কাজ) শুরু করছি সেটা হলো আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের টাকার সুদ। জাহেলিয়াতের যুগ থেকে যদি কারো ওপর কোনো রক্তের দায় থেকে থাকে, তা হলে (এখন) তা বহাল থাকবে না। আর সর্বপ্রথম যার রক্তের দায় মাফ করলাম সে হলো আমের ইবনে রাবিয়্যাহ্, হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র।

বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে আরো বলেছেন:”নিশ্চয়ই জাহেলি যুগের সব প্রথা ও আইন অকার্যকর, কেবল কাবাঘরের তত্ত্বাবধান আর হাজীদের আপ্যায়ন ছাড়া। ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য রয়েছে কিসাস বা বদলা।”

“হে লোকেরা! শয়তান তোমাদের এ ভূমিতে পূজিত হওয়া থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু সন্তুষ্ট হয়েছে যে, উপাসনা ব্যতীত অন্যান্য ছোট কাজে তার নির্দেশের আনুগত্য করা হবে। হে লোকেরা! ( যেসব মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ সেইসব মাসকে) তথা পবিত্র বা হারাম মাসগুলোকে অগ্র-পশ্চাত করা ( তথা অন্যান্য মাসের সাথে পরিবর্তন করা) কুফরেরই বিস্তার মাত্র। যারা কাফের তারা এর মাধ্যমে মানুষকে পথভ্রষ্ট বা গোমরাহ্ করে। এক বছরে সেটাকে হালাল করে, আরেক বছরে সেটাকে করে হারাম। যাতে আল্লাহ্ যে মাসগুলোকে হারাম করেছেন সেগুলোর সমান হয়ে যায়।”

নিশ্চয়ই সময় ঘুরে সেদিনের অবস্থায় পৌঁছেছে যেদিন আল্লাহ্ আকাশগুলো এবং জমিনকে সৃষ্টি করেন। ‘নিশ্চয় মাসগুলোর সংখ্যা আল্লাহর কাছে বারোটি, আল্লাহর কিতাবে, যেদিন আসমানগুলো ও জমিনকে সৃষ্টি করেন, তন্মধ্যে চারটি মাস হারাম। তিনটি একাদিক্রমে। আর সেগুলো হল- জিলক্বদ, জিলহজ্ব এবং মুহররম। আর একাকী হল রজব -যা জমাদি ও শাবানের মাঝে। আমি কি প্রচার করিনি? হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাকো।”

বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে আরো বলেছেন: “হে লোকেরা! নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের ওপর অধিকার রাখে। আর তাদের ওপরও তোমাদের অধিকার রয়েছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো তোমাদের বিছানায় (অর্থাৎ বিবাহ বন্ধনে থাকা অবস্থায় তারা) অন্য কারো সাথে সহবাস করবে না। আর যাকে তোমরা অপছন্দ করো তাকে তোমাদের অনুমতি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করতে দেবে না। আর ব্যভিচার করবে না। আর যদি তা করে তা হলে আল্লাহ্ অনুমতি দিয়েছেন যে, তোমরা তাদের ওপর কঠোর হবে, তাদের বিছানাকে বর্জন করবে এবং তাদেরকে প্রহার করবে। তবে এমনরূপে নয় যে যখমি হবে কিংবা কালচে দাগ পড়ে যাবে। অতঃপর যখন তোমাদের কাছে ফিরে আসে এবং তোমাদের আনুগত্য করে তখন তোমাদের ওপর কর্তব্য হলো তাদেরকে ন্যায়সঙ্গতভাবে খোরাক ও পোশাক দেবে। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ আর আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ মতো তাদেরকে নিজের জন্য হালাল করেছ। স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো এবং তাদের সাথে সদাচরণ করো।”

বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে আরো বলেছেন: “হে লোকেরা! মুমিনরা পরস্পর ভাই। মুমিন ভাইয়ের সম্পদ তার জন্য বৈধ নয় যদি না সে সম্মত থাকে। আমি কি (আল্লাহর নির্দেশ) উম্মতের কাছে পৌঁছাইনি? হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী। তোমরা কুফরে প্রত্যাবর্তনের পথ ধরো না যে, একে অপরকে হত্যা করবে। কারণ, আমি তোমাদের মধ্যে এমন জিনিস রেখে গেলাম যা তোমরা যদি ধারণ করো, তা হলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না : আল্লাহর কিতাব এবং আমার মনোনীত বংশধর -আহলে বাইত। আমি কি পৌঁছাই নি? হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী।”

“হে লোকেরা! নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতা এক। তোমরা সবাই আদম থেকে আর আদম হলো মাটি থেকে। তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানিত যে বেশি খোদাভীরু। আর আরবের ওপর অনারবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই তাকওয়া ব্যতীত। কি, আমি কি পৌঁছাই নি?” সবাই বলল : অবশ্যই। তিনি বললেন : সুতরাং উপস্থিতরা যেন অনুপস্থিতদেরকে সংবাদ দেয়।

বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে আরো বলেছেন: “হে লোকেরা! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ প্রত্যেক উত্তরাধিকারীকে উত্তরাধিকারের অংশ দান করেছেন। আর পরিত্যক্ত সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করলে তা কার্যকর নয়। সন্তান হবে স্বামীর আর ব্যভিচারীর কপালে জুটবে পাথর। যে কেউ নিজ পিতা ছাড়া অন্যের প্রতি নিজের পিতৃত্ব আরোপ করে এবং যে নিজ মনিব ভিন্ন অন্যকে মনিব বলে পরিচয় দেয় তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ, অভিশাপ বর্ষিত হোক ফেরেশতাকুল এবং সব মানুষের। আর আল্লাহ্ তার কাছ থেকে কোনো তওবা এবং বদলা গ্রহণ করেন না। আল্লাহর দরুদ ও করুণা বর্ষিত হোক তোমাদের ওপর।”

তিনি আরো বলেছেন, দু’টি কাজের চেয়ে উত্তম কোনো পুণ্যের কাজ নেই : আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং আল্লাহর বান্দাদের উপকার করা। আর দু’টি কাজের চেয়ে জঘন্য কোনো কাজ নেই : আল্লাহর সঙ্গে শির্ক করা আর আল্লাহর বান্দাদের ক্ষতি করা।

এক ব্যক্তি বিশ্বনবী (সা.)-কে বলল : আমাকে কিছু উপদেশ দিন যার মাধ্যমে আল্লাহ্ আমার মঙ্গল করবেন। তখন হুজুর (সা.) বললেন : বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করো, তা তোমাকে দুনিয়া (প্রেম) থেকে মুক্ত করবে। (আল্লাহর প্রতি) কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো, কারণ, তা নেয়ামতকে বাড়িয়ে দেয়। বেশি বেশি দোয়া করো, কেননা তুমি জান না কখন তোমার দোয়া গ্রহণ করা হবে। সীমালঙ্ঘন করো না। কারণ, আল্লাহ্ এরূপ নির্ধারণ করেছেন যে, যার সীমা লঙ্ঘিত হয় আল্লাহ্ অবশ্যই তার সহায় হন। (মহান আল্লাহ) ইরশাদ করেন,

হে লোকেরা! তোমাদের সীমা লঙ্ঘনের ক্ষতি তোমাদের ওপরই বর্তাবে। (ইউনুস:২৩) আর যেন প্রতারণা করো না। কারণ, আল্লাহ্ এরূপ নির্ধারণ করেছেন যে, ‘মন্দ প্রতারণা কেবল তার কর্তাকেই পরিবেষ্টন করে থাকে।’ (ফাতির:৪৩)

মহানবী (সা.) আরো বলেছেন : শিগগিরই তোমরা শাসন ক্ষমতার প্রতি লালায়িত হবে। তখন তোমাদের পরিণাম হবে আফসোস আর অনুতাপ।

তিনি আরো বলেন : সেই জাতি কখনো সফল হবে না যারা তাদের সামাজিক নেতৃত্বভার নারীর হাতে ন্যস্ত করে।

হুজুর (সা.)-এর কাছে আরজ করা হলো : কোন্ সঙ্গীরা উত্তম?  তিনি বললেন : যখন তুমি তাকে স্মরণ করবে, সে তখন তোমাকে সাহায্য করবে; আর যখন ভুলে যাবে সে তখন তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। আরো বলা হলো : নিকৃষ্টতম লোক কারা? বললেন : জ্ঞানী লোকেরা যখন নষ্ট হয়ে যায়।

মহানবী আরো বলেন, আমার প্রতিপালক আমাকে নয়টি বিষয়ের উপদেশ দিয়েছেন : প্রকাশ্য ও গোপনে নিষ্ঠা অবলম্বন করা, সন্তুষ্টি আর ক্রোধের অবস্থায় ন্যায়পরায়ণ থাকা, অভাব ও প্রাচুর্যের সময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা, আর যে আমার প্রতি অত্যাচার করে তাকে যেন ক্ষমা করি, আর আমার প্রতি যে কৃপণতা করে তাকে প্রদান করা, আর যে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তার সাথে যেন সম্পর্ক গড়ি, আর আমার নীরবতা যেন হয় চিন্তা-গবেষণা, আর আমার কথা যেন হয় যিকির আর আমার তাকানো যেন হয় শিক্ষা গ্রহণ।

বিশ্বনবী (সা.) বলেন : জ্ঞানকে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে বেঁধে ফেল।

তিনি আরো বলেন : যখন কোনো জাতির দুর্বৃত্তরা তাদের নেতা হয়, তাদের নিকৃষ্টরা হয় কর্ণধার আর দুষ্কৃতকারীদেরকে সম্মান করা হয়, তা হলে যেন তারা বিপদের অপেক্ষায় থাকে।

মহানবী (সা.) বলেন, অন্যদিকে যখন তোমাদের নেতারা হয় তোমাদের উত্তম লোকেরা, আর তোমাদের সামর্থ্যবানরা হয় তোমাদের দানশীল লোকেরা, আর তোমাদের কাজকর্ম হয় তোমাদের সবার পরামর্শ অনুযায়ী তা হলে তোমাদের জন্য মাটির উপরিভাগই মাটির ভেতরের চেয়ে উত্তম হবে। আর যখন তোমাদের নেতারা হয় তোমাদের নিকৃষ্টরা, আর তোমাদের সামর্থ্যবানরা হয় তোমাদের কৃপণরা, আর তোমাদের কাজকর্ম ন্যস্ত হয় তোমাদের নারীদের ওপর তখন তোমাদের জন্য মাটির ওপরের চেয়ে নিচে থাকাই শ্রেয়।

তিনি আরো বলেন : দ্রুত বেগে হাঁটা মুমিনের মূল্য কমিয়ে দেয়।

মহানবী (সা.) বলেন : যার (মাল) চুরি হয় সে সবসময় নিরপরাধ লোকদেরকে দোষারোপ করতে থাকে। ফলে তার অপরাধ চোরের চেয়েও বড় হয়ে যায়।

তিনি আরো বলেন : আল্লাহ্ তাকে ভালোবাসেন যে, তাঁর অধিকার আদায় করার ক্ষেত্রে উদারতা প্রদর্শন করে।

মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তির সকাল ও সন্ধ্যা অতিবাহিত হয় এ অবস্থায় যে, তার তিনটি জিনিস থাকে, তবে তার ওপর দুনিয়ার নেয়ামত পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যার সকাল ও সন্ধ্যা অতিবাহিত হয় সুস্থ অবস্থায়, তার মনে প্রশান্তি থাকে আর তার কাছে একদিনের জীবিকা থাকে। আর যদি চতুর্থ বস্তুটিও  যদি তার থাকে তা হলে তার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল নেয়ামত পূর্ণ হয়। আর সেটা হলো ঈমান।

তিনি আরো বলেন : দয়া করো সেই সম্মানিতের ওপর যে লাঞ্ছিত হয়েছে, আর সেই ধনীর ওপর যে নিঃস্ব হয়েছে আর ঐ জ্ঞানীর ওপর যে মূর্খদের কবলে পড়েছে।

আল্লাহর শেষ নবী আরো বলেন : দুটি ব্যাপারে অসংখ্য মানুষ ধোঁকা খেয়ে থাকে, সুস্থতা আর অবসর। (অর্থাৎ এগুলোর সদ্ব্যবহার করে না।)

তিনি আরো বলেন : অন্তরগুলো ঐসব লোকের বন্ধুত্বে বাধা পড়ে যারা তাদের প্রতি সদাচার করেছে আর ঐসব লোকের শত্রু  হয় যারা তাদের প্রতি অনিষ্ট করেছে।

হুজুর (সা.) বলেন : নবীদেরকে মানুষের সাথে তাদের বিবেক-বুদ্ধি অনুপাতে কথা বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন : সেই ব্যক্তি অভিশপ্ত যে নিজের রুজির ভার অন্যের ওপর ন্যস্ত করেছে।

তিনি  বলেন : ইবাদতের সাতটি অঙ্গ। তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো হালাল রুজি অর্জন করা।

মহানবী (সা.) আরো বলেন : নিশ্চয় আল্লাহ্ জোরজবরদস্তি করে আনুগত্য গ্রহণ করেন না আবার কারো অবাধ্যতার মাধ্যমে তিনি পরাস্তও হন না। বান্দাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা থেকে তিনি হাত গুটিয়ে নেন নি। অথচ তিনি যেসব জিনিসের ওপরে তাদেরকে ক্ষমতাশীল করেছেন সেসবের ওপর পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী। আর তিনিই হলেন সব রাজত্বের মালিক যা তাদেরকে দান করেছেন। সত্যিই যদি সব বান্দা খোদার আনুগত্যে অবিরত লিপ্ত থাকে, তা হলেও কোনো অন্তরায় ও প্রতিবন্ধক নেই। আবার যদি তারা আল্লাহর অবাধ্যতার কাজ করে তবে তিনি চাইলে তাদের এবং তারা যা করে তার মাঝে প্রতিবন্ধক হতে পারেন।

মহানবীর পুত্র ইবরাহীম যখন মৃত্যুবরণ করছিল (তখন  তিনি বলেন) : যা অতীত হয়েছে তা যদি (আল্লাহর কাছে) প্রেরিত সঞ্চিত বস্তু না হতো আর শেষও প্রথমের সাথেই সংযুক্ত (সকলকেই মৃত্যুর পরিণতি বরণ করতে) না হতো, তা হলে আমরা তোমার ওপর তীব্রভাবে শোকাহত হতাম হে ইবরাহীম। এরপর তাঁর চক্ষু অশ্রুসিক্ত হলো এবং তিনি বললেন, চক্ষু অশ্রু ঝরায়, আর অন্তর শোকার্ত হয়। আর আমরা শুধু সেটাই বলি যা আল্লাহর পছন্দনীয়। আর সত্যই হে ইবরাহীম! আমরা তোমার জন্য শোকাহত।

তিনি বলেছেন : জ্ঞানকে জনগণের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া যায় না, কিন্তু যতক্ষণ অবধি জ্ঞানীরা থাকে ততক্ষণ জ্ঞানীদের অপহরণ করা হয় ফলে আর কোন জ্ঞানী অবশিষ্ট থাকে না, আর তখন জনগণ মূর্খদেরকেই নেতা হিসাবে গ্রহণ করে। ফতোয়া চাওয়া হয় আর তারা না জেনে ফতোয়া প্রদান করে। ফলে নিজেরাও পথভ্রষ্ট থাকে, আর অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করে।

তিনি বলেন : আমার উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ হলো ফারাজ তথা মুক্তির অপেক্ষা করা (তথা ইমাম মাহদি –আ.’র বিশ্ব-বিপ্লবের সদস্য হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা)।

আমরা (আমিসহ আমার আহলে বাইতের) আহলে বাইতের পৌরুষত্ব হলো যে আমাদের ওপর অত্যাচার করে তাকে ক্ষমা করা আর যে আমাদের প্রতি কৃপণতা করে তাকে দান করা।

তিনি  আরো বলেন : আমার উম্মতের মধ্যে থেকে আমার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বন্ধুরা হলো যে ব্যক্তির বোঝা হালকা, নামাজি, নির্জনে নিজ প্রতিপালকের উত্তম ইবাদত করে, জনগণের মধ্যে থাকে অজ্ঞাত, তার রুজি হয় দিনাতিপাত করার পরিমাণে এবং তার ওপরেই ধৈর্যধারণ করে থাকে। আর যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার উত্তরাধিকারের সম্পদ থাকে স্বল্প আর তার ওপর ক্রন্দনকারীর সংখ্যা হয় কম।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : মুমিনকে কোনো কাঠিন্য, অসুস্থতা ও দুঃখ স্পর্শ করলে তাতে যদি তার সামান্য কষ্টও হয় আল্লাহ সেটির বিনিময়ে তার পাপগুলো মোচন করেন।

তিনি বলেন : যে ব্যক্তি ইচ্ছামত খায়, ইচ্ছামত পরিধান করে আর ইচ্ছামত বাহনে আরোহণ করে, আল্লাহ্ তার ওপর অনুগ্রহের দৃষ্টি ফেলেন না যতক্ষণ না সে তা হারায় কিংবা বর্জন করে (এবং তওবা করে)।

মহানবী বলেন : মুমিন হলো একটি গমের শীষের মতো যা কখনো মাটিতে নুয়ে পড়ে আবার কখনো নিজ পায়ে দাঁড়ায়। আর কাফের হলো শক্ত গাছের মতো যা সব সময় দাঁড়িয়ে থাকে এবং কোনো সংবেদনের অধিকারী নয় (যে ন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে।)

তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, মানুষের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি কঠিনতর পরীক্ষার সম্মুখীন? উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন : নবীগণ, অতঃপর সত্য পথে তাদের অনুরূপ ও সদৃশতমগণ। আর মুমিনের ঈমানের মাত্রা ও সৎকর্মের পরিমাণ অনুযায়ী তাকে পরীক্ষা করা হয়। যখন তার ঈমান সঠিক এবং কর্ম সৎ হবে তখন তার পরীক্ষাও কঠিনতর হবে। আর যার ঈমান নিকৃষ্ট আর কর্ম দুর্বল হবে তার পরীক্ষাও কম হবে।

মহানবী (সা.) আরো বলেন : যদি আল্লাহর কাছে দুনিয়া(র মূল্য) একটি মশার ডানার সমানও হতো তা হলে কাফের ও মুনাফিকদেরকে কিছুই দিতেন না। দুনিয়া পরিবর্তনশীল (এক হাত থেকে আরেক হাতে আবর্তনশীল)। যা কিছু তোমার প্রাপ্য সেটা তোমার শত অক্ষমতা সত্ত্বেও অর্জিত হয়। আর (দুনিয়ার) যা কিছু তোমার জন্য অনিষ্টকর সেটা তুমি তোমার শক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে পারবে না। যে ব্যক্তি তার হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার আশা ত্যাগ করে তার শরীর আরামে থাকে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তার জন্য যা কিছু বরাদ্দ করেছে তাতে সন্তুষ্ট থাকে তার চোখ উজ্জ্বল হয়।

হুজুর (সা.) বলেন : সত্যি কথা বলতে কি, খোদার কসম! এমন কোনো কাজই নেই যা তোমাদেরকে জাহান্নামের কাছে নেয় আর আমি তোমাদেরকে সে ব্যাপারে অবগত করিনি কিংবা তোমাদেরকে তা থেকে বারণ করিনি। অন্যদিকে এমন কোনো কাজই নেই যা তোমাদেরকে বেহেশতের কাছে নেয় আর আমি তোমাদেরকে সে ব্যাপারে অবগত করিনি কিংবা তার আদেশ করি নি। কারণ, রুহুল আমিন (জিবরাইল) আমার হৃদয়ে এ কথা প্রক্ষিপ্ত করেন যে, কখনোই কোনো প্রাণী মৃত্যুবরণ করে না, যতক্ষণ না নিজের নির্ধারিত রুজি লাভ করে থাকে। রুজির কামনায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর (ও বাড়াবাড়ি কর না)। বিলম্বে রুজি পৌঁছানো যেন তোমাদেরকে ঐ পথে ঠেলে না দেয় যে, আল্লাহর কাছে যা কিছু তোমাদের জন্য রয়েছে সেগুলোকে অবাধ্যতার পথ দিয়ে অন্বেষণ করো (হারামভাবে অর্জন করো) কারণ, যা কিছু আল্লাহর কাছে রয়েছে তা শুধু তাঁর আনুগত্যের মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনোভাবে লাভ করা যায় না।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন : আল্লাহ্ দু’টি স্বরকে ঘৃণা করেন : বিপদের সময় চিৎকার করে কান্নাকাটি করা আর নেয়ামত লাভ ও খুশীর সময় বাঁশি বাজানো (গান-বাজনা করা)।

তিনি বলেন : সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষণ হলো তাদের (দ্রব্যগুলোর) মূল্য সস্তা হওয়া এবং তাদের শাসকের ন্যায়বিচারক হওয়া। আর সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর ক্রোধের লক্ষণ হলো তাদের শাসকদের অবিচারক হওয়া এবং তাদের (পণ্য-দ্রব্যগুলোর) মূল্য চড়া হওয়া।

তিনি আরো বলেন, চারটি জিনিস যার মধ্যে থাকে সে আল্লাহর মহিমাময় জ্যোতি-সমৃদ্ধ হয় : যার সব কাজের আশ্রয়স্থল হয় আল্লাহর একত্ববাদ এবং আমি তাঁর প্রেরিত হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান, তার ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ অর্থাত বলে, ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর কাছ থেকে এসেছি আবার আল্লাহর কাছেই ফিরে যাব’।’আর ভালো কিছু লাভ করলে তখন বলে ‘আল হামদুলিল্লাহ্।’আর অপরাধ করলে বলে ‘আসতাগফিরুল্লাহ্ ওয়া আতুবু ইলাইহি। অর্থাত আমি আল্লাহর ক্ষমা চাচ্ছি ও আল্লাহর কাছেই ফিরছি।’

মহান আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল (সা.) বলেন, যাকে চারটি জিনিস দেয়া হয় তাকে আর চারটি জিনিস দেয়া থেকে কুণ্ঠা করা হয় না : যাকে ক্ষমা প্রার্থনার সুযোগ দেয়া হয় তাকে মার্জনা থেকে বঞ্চিত করা হয় না, আর যাকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে দেয়া হয়, তাকে বেশি অনুগ্রহ লাভ থেকে বঞ্চিত করা হয় না, আর যাকে তওবা করার (অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসার) তৌফিক দেয়া হয় তাকে তওবা গৃহীত হওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয় না। আর যাকে প্রার্থনার অনুমতি দেয়া হয় তাকে তা মঞ্জুর হওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয় না।

মহানবী (সা.) বলেন : জ্ঞান হলো গুপ্ত ভাণ্ডার তুল্য। আর তার চাবি হলো প্রশ্ন। অতএব, প্রশ্ন করো, আল্লাহ্ তোমাদের অনুগ্রহ করবেন। কারণ, চার ব্যক্তির জন্য পুরস্কার ও পারিশ্রমিক রয়েছে : প্রশ্নকারী, বক্তা, শ্রোতা আর তাদের ভক্তিকারী।

তিনি আরো বলেন : জ্ঞানীদের কাছে প্রশ্ন করো আর হাকিম বা প্রজ্ঞাবানদের সাথে সংলাপ করো, আর দরিদ্রদের সাথে ওঠা-বসা করো।

মহানবী (সা.) বলেন : আমার কাছে জ্ঞানের মর্যাদা ইবাদতের মর্যাদার চেয়ে বেশি প্রিয়। তোমাদের সবচেয়ে বড় ধর্ম হল পরহিজগারিতা (আত্মসংযম)।

তিনি আরো বলেন : যে ব্যক্তি না জেনে জনগণের মধ্যে ফতোয়া প্রদান করে তার ওপরে আসমান ও জমিনের ফেরেশতারা অভিশাপ দেয়।

তিনি আরো বলেছেন : আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক বা শির্ক করো না, এমনকি যদি আগুনেও পোড় এবং শাস্তির মুখোমুখি হও। ফলে তোমার অন্তর ঈমানে অবিচল হবে। আর তোমার বাবামায়ের আনুগত্য করো এবং তাদের সঙ্গে সদাচার করো, তাদের জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর। আর ফরয নামাযকে ইচ্ছাকৃতভাবে ত্যাগ করো না। কারণ, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ফরয নামাযকে ত্যাগ করে সে আল্লাহর আশ্রয় থেকে বিতাড়িত। আর মদ ও অন্য কোনো নেশা-দ্রব্য পান করো না, কারণ, এ দু’টি হলো সকল অনিষ্টের চাবিকাঠি।

বনি তামীমের জনৈক ব্যক্তি যাকে আবু উমাইয়্যা নামে ডাকা হতো, হুজুর (সা.)-এর কাছে এসে বলল : হে মুহাম্মদ! আপনি মানুষকে কিসের দিকে আহ্বান জানান? উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন : “আমি আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাই অন্তর্দৃষ্টিসহ- আমি ও যারা আমাকে অনুসরণ করেছে তারাও।” (ইউসুফ:১০৮) আমি তাঁর দিকেই আহ্বান জানাই যিনি তোমার থেকে ক্ষতিকে দূর করে দেন যখন তা তোমাকে স্পর্শ করে এবং তুমি তাঁকে ডাক। আর বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তুমি যদি তাঁকে ডাক, তা হলে তোমাকে সাহায্য করেন। আর নিঃস্ব অবস্থায় তুমি যদি তাঁর কাছে সাহায্য চাও, তা হলে তোমাকে অভাবমুক্ত করে দেবেন।

এরপর লোকটি বলল : হে মুহাম্মদ! আমাকে উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন : ক্রুদ্ধ হবে না। সে বলল : আরো কিছু বলুন। তিনি বললেন: মানুষের জন্য সেটাই পছন্দ করো, যা তোমার নিজের জন্য পছন্দ করো। সে বলল : আরো কিছু বলুন। তিনি বললেন : মানুষকে গালমন্দ করো না। এতে তারা তোমার শত্রুতে পরিণত হবে। সে বলল : আরো কিছু বলুন। তিনি বললেন : উপযুক্ত পাত্রদের উপকার করতে কার্পণ্য কোরো না।

সেই ব্যক্তি বিশ্বনবী (সা.)-কে আরো বললেন : আরো কিছু বলুন। তিনি বললেন : মানুষকে ভালোবাসবে, তা হলে তারাও তোমাকে ভালোবাসবে। আর তোমার ভাইয়ের সাথে প্রসন্ন মুখে সাক্ষাত করো। আর অসদাচারণ করো না, তা হলে তা তোমাকে ইহকাল ও পরকাল (উভয় জগতের কল্যাণ) থেকে বঞ্চিত করবে। আর পায়ের গোঁছার মাঝখান পর্যন্ত লম্বা জামা পড়বে। আর নিজের জামা ও পায়জামাকে এত দীর্ঘ করো না যে তা মাটিতে ঘেঁষে যায়। কারণ, এ কাজ হলো অহংকারের পরিচায়ক। আর আল্লাহ্ অহংকারীকে পছন্দ করেন না।

তিনি আরো বলেন : নিশ্চয় আল্লাহ্ ঘৃণা করেন বৃদ্ধ ব্যভিচারীকে, বিত্তবান অত্যাচারীকে, অহংকারী গরীবকে এবং নাছোড়বান্দা ভিক্ষুককে। আর নিষ্ফল করেন প্রচার করে বেড়ানো দানশীলদের পুরস্কারকে আর ঘৃণা করেন এমন ফুর্তিবাজকে যে বেপরোয়া ও মিথ্যাচারী।

তিনি আরো বলেন : যে ব্যক্তি নিজেকে নিঃস্ব হিসাবে প্রকাশ করে সে অভাবগ্রস্ত হয়।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : মানুষের সাথে মানিয়ে চলা ঈমানের অর্ধাংশ। আর তাদের সঙ্গে নরম ব্যবহার হলো সুখী জীবনের অর্ধাংশ।

তিনি বলেন : আল্লাহর প্রতি ঈমানের পর সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তার কাজ হলো মানুষের সাথে মানিয়ে চলা যতক্ষণ না কোনো অধিকার ত্যাগ করা হয়। আর পুরুষের জন্য কল্যাণকর হলো তার দাড়ি হালকা রাখা।

তিনি বলেন : আমার জন্য মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ হওয়ার পর সবচেয়ে কড়াকড়িভাবে যেটা নিষেধ করা হয়েছে তা হল মানুষের সঙ্গে বিবাদ করা।

মহানবী আরো বলেন : যে ব্যক্তি মুসলমানকে ফাঁকি দেয় কিংবা তার ক্ষতি করে অথবা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।

মহানবী (সা.) মসজিদুল খিফ-এ দাঁড়িয়ে বললেন : আল্লাহ্ প্রফুল্ল করেন সেই বান্দাকে যে আমার কথা শুনে তা স্মৃতিতে ধরে রাখে এবং যে শোনে নি তার কাছে পৌঁছে দেয়। কত জ্ঞান প্রচারকারীর চেয়ে ঐ ব্যক্তি বেশি ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন যার কাছে সে জ্ঞানকে পৌঁছায়। কত জ্ঞানের বাহক রয়েছে যে আদৌ জ্ঞানী নয়।

মহানবী (সা.) আরো বলেছেন: তিনটি বিষয়ে কোনো মুসলমানের অন্তরে বিদ্বেষ থাকতে পারে না : আল্লাহর জন্য কাজে একনিষ্ঠতা, মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য কল্যাণকামিতা এবং তাদের ঐক্যের অপরিহার্যতা। সব মুমিনই ভাই ভাই। তাদের রক্ত (মর্যাদার দিক থেকে) পরস্পর সমান। অন্যদের বিপরীতে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে আর তাদের অঙ্গীকার পালনের প্রচেষ্টা চালাবে এমনকি যদি তাদের নিম্নশ্রেণীর কোন লোকও (তাদের ভিন্ন অন্যের সাথে) কোন বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

তিনি বলেন : আল্লাহ্ ঐ বান্দাকে অনুগ্রহ করেন যে হয় উত্তম কথা বলে এবং লাভবান হয়, অথবা মন্দ থেকে নীরব থাকে, ফলে নিরাপদ থাকে।

বিশ্বনবী (সা.) বলেন : তিনটি জিনিস যার মাঝে থাকে তার ঈমানের বৈশিষ্ট্য পূর্ণাঙ্গ হয় : যার সন্তুষ্টি তাকে বাতিল বা মিথ্যার দিকে নেয় না, আর যখন রাগ হয় তখন তার রাগ তাকে সত্য ও ন্যায় থেকে বিচ্যুত করে না, আর যখন ক্ষমতা পায় তখন যা তার প্রাপ্য নয় তার দিকে হাত বাড়ায় না।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেন : নামাযের অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা নামাযের বাইরে কুরআন তিলাওয়াতের চেয়ে উত্তম। (প্রথম দিকের মুসলমানদের মধ্যে এ পন্থা চালু ছিল যে, নফল নামাযের মধ্যে কোরআন পাঠ ও হিফজ করার অনুশীলন করত। নফলের পেছনে হিকমত ছিল এটাই। আর এ কারণে তা ফোরাদা বা একাকী পড়া আবশ্যক যাতে মনোসংযোগ বজায় থাকে।) আল্লাহর যিকর সাদাকার চেয়ে উত্তম। আর সাদাকাহ্ রোযার চেয়ে উত্তম। আর রোযা হলো ভালো কাজ। এরপর বলেন : কাজ ছাড়া কোনো কথা নেই। আর কোনো কথা ও কাজ নেই নিয়ত ছাড়া। আর কোনো কথা, কাজ এবং নিয়তই নেই সঠিক পন্থা তথা ধর্মীয় বিধান-সম্মত হওয়া ছাড়া।

মহানবী (সা.) আরে বলেছেন : ধীরতা আল্লাহর থেকে আর তাড়াহুড়া শয়তানের থেকে।

আর যে ব্যক্তি নিজেকে এমন পদে বসায় যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য নির্ধারিত স্থান থেকে ভিন্ন, আল্লাহ্ তার ওপর ক্রুদ্ধ হন। আর যে ব্যক্তি জনগণকে নিজের দিকে আহ্বান করে এবং বলে আমি তোমাদের সর্দার, অথচ সে সেরূপ নয়, আল্লাহ্ তার দিকে তাকান না যতক্ষণ না সে তার কথা থেকে ফিরে আসে এবং আল্লাহর দরবারে নিজের ওই দাবি থেকে তওবা করে।

তিনি আরো বলেন : তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আমার থেকে সবচেয়ে দূরে যে কৃপণ, কটুভাষী ও গালমন্দকারী।

মহানবী (সা.) বলেন : দুর্ব্যবহার হল অনিষ্টতা।বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : যখন কোনো লোককে দেখবে যে, নিজে কি বলে কিংবা তার সম্পর্কে কি বলা হয় সে ব্যাপারে পরোয়া করে না নিশ্চয় সে জারজ, না হয় শয়তান।

তিনি বলেন : আল্লাহ্ বেহেশত নিষিদ্ধ করেছেন প্রত্যেক কটুভাষী গালমন্দকারী ও লজ্জাহীন লোকের জন্য যে পরোয়াই করে না যে, কি বলছে কিংবা তার সম্পর্কে কি বলা হচ্ছে। জেনে রাখ, যদি তার বংশ তল্লাশি করো তা হলে দেখতে পাবে যে, হয় সে জারজ, না হয় শয়তানের ঔরস থেকে। বলা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! মানুষের মধ্যে কি শয়তান রয়েছে? বললেন : হ্যাঁ, তোমরা কি পড়ো না, আল্লাহর বাণী, ‘আর অংশীদার হও তাদের মাল-সম্পদে আর সন্তান-সন্ততিতে।’

তিনি আরো বলেন : যাকে তুমি উপকার করবে সে তোমার উপকার করবে। আর যে ব্যক্তি সময়ের অপ্রত্যাশিত দিনগুলোর জন্য ধৈর্যের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে না সে ব্যর্থ হবে। আর যে মানুষের ভুল-ত্রুটি ধরে তারাও তার ভুল-ত্রুটি ধরবে। আর যতই মানুষকে ছাড় দিক না কেনো তারা তাকে ছাড় দিবে না। বলা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! তা হলে আমরা কী করব? তিনি বললেন : তোমরা তোমাদের সম্মান বা সম্পদ থেকে তাদেরকে ধার তথা তাদের জন্য শ্রম ও অর্থ দাও তোমাদের অভাবের দিনের জন্য।

মহানবী (সা.) বলেন : আমি কি তোমাদেরকে ইহকাল ও পরকালের সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের নির্দেশনা দান করব না? তার সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগাও যে তোমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে, আর দান করো তাকে যে তোমার সঙ্গে কৃপণতা করেছে, আর ক্ষমা করো তাকে যে তোমার ওপর অত্যাচার করেছে।

একদিন বিশ্বনবী (সা.) বের হলেন যখন একদল লোক একটি পাথরকে নিক্ষেপ করছিল। তখন তিনি বললেন : তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হলো সে যে রাগের সময় আত্মসংবরণ করতে পারে আর সবচেয়ে বড় ভারোত্তলনকারী হলো সে যে (প্রতিশোধ গ্রহণের) ক্ষমতা থাকার পরও ক্ষমা প্রদর্শন করে।তিনি বলেছেন : তোমাদের মধ্যে ঈমানের দিক দিয়ে সেই সর্বোত্তম যে সবচেয়ে বেশি সচ্চরিত্রবান।

মহানবী বলেন : সচ্চরিত্র তার অধিকারীকে সারাদিন রোযা রাখা ও সারারাত জেগে ইবাদত করা ব্যক্তির সমান মর্যাদায় পৌঁছে দেয়। তখন বলা হলো : বান্দার প্রতি সবচেয়ে উত্তম দান কী? তিনি বললেন : উত্তম চরিত্র।

তিনি বলেন : সচ্চরিত্র বন্ধুত্বকে মজবুত করে।তিনি আরো বলেছেন : হাসিখুশি মুখ শত্রুতাকে দূর করে দেয়। আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল (সা.) বলেন : তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিরাই হলো সর্বোত্তম যারা (অপরের সাথে সহজেই) সম্পর্ক গড়ে এবং (তাদের) সম্প্রীতির আহ্বানকে গ্রহণ করে।

মহানবী বলেন : হাতগুলো তিন ধরনের : প্রার্থীর, দানশীলের আর কৃপণের। আর সর্বোৎকৃষ্ট হাত হলো দানশীল হাত।তিনি বলেন : লজ্জা দু’টি : বুদ্ধিমত্তার লজ্জা আর বোকামি-প্রসূত লজ্জা। বুদ্ধিমত্তার লজ্জা জ্ঞানের পরিচয় বহন করে আর বোকামি-প্রসূত লজ্জা মূর্খতার পরিচায়ক।তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন : যে ব্যক্তি লজ্জার ঢাকনাটি দূরে ফেলে দেয় তার গীবতে (বা পরনিন্দা) কোনো দোষ নেই।মহানবী বলেন : যে ব্যক্তি আল্লাহতে এবং পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন কৃত অঙ্গীকার রক্ষা করে।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : আমানতদারী (বিশ্বস্ততা) রুজি আনে আর বিশ্বাসঘাতকতা আনে অভাব ও দরিদ্রতা।তিনি বলেন : সন্তান যখন তার বাবা মায়ের দিকে মমতাপূর্ণ দৃষ্টি দেয় তা হয় ইবাদতের সমতুল্য।

তিনি বলেন : কঠিন বিপদ হলো যখন কোনো লোককে হাত বেঁধে সামনে আনা হয় এবং তার গর্দান নেয়া হয়। আর বন্দী যতক্ষণ শত্রুর হাতে আটক থাকে এবং কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর পেটের ওপর আরেক জন পুরুষকে দেখতে পায়।

সম্ভবত রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) তাঁর সহচরদের বলেন : নিজেদেরকে আল্লাহর বন্ধু করো এবং তাঁর নৈকট্য লাভ করো। তারা বলল : হে রুহুল্লাহ্! কিভাবে আমরা নিজেদেরকে আল্লাহর বন্ধু করব? তিনি বললেন : অবাধ্য ও পাপাচারী লোকদেরকে ঘৃণা আর তাদের ক্রোধের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অন্বেষণ করো। তারা বলল : হে রুহুল্লাহ্! তা হলে কাদের সাথে আমরা ওঠাবসা করব? তিনি বললেন : তার সাথে যাকে দেখলে তোমার মনে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, আর যার কথা তোমার জ্ঞানকে বাড়িয়ে দেয়, আর যার কাজ তোমাকে পরকালের প্রতি উৎসাহিত করে।সম্ভবত রাসূল (সা.) থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ্ বলেছেন : ‘এটা তথা ইসলাম হলো সেই ধর্ম যা আমি নিজের জন্য পছন্দ করেছি। আর উদারতা ও সচ্চরিত্র ছাড়া তা উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয় না। কাজেই তোমরা যতক্ষণ ইসলামের সহচর থাকবে এবং এ দু’টির মাধ্যমে তার মর্যাদা রক্ষা করবে।’

তিনি বলেন : এক ব্যক্তি পান করার জন্য দুধ ও মধু আনল। তখন তিনি (সা.) বললেন : দু’টি পানীয় রয়েছে। এ দুটি থেকে একটিই যথেষ্ট। আমি একটা পান করব না, নিষিদ্ধও করব না। কিন্তু আল্লাহর জন্য বিনয়ী হব। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ্ তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। আর যে অহংকার করে, আল্লাহ্ তাকে অপদস্থ করেন। আর যে ব্যক্তি জীবনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে, আল্লাহ্ তাকে রুজি দান করেন। আর যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ্ তাকে বঞ্চিত করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে বেশি বেশি জিকর বা স্মরণ করে আল্লাহ্ তাকে পুরস্কার দান করেন।

মহানবী (সা.) বলেন : কাল কিয়ামতের মাঠে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আমার বেশি কাছে থাকবে যে তোমাদের মধ্যে বেশি সত্যবাদী, বেশি আমানত রক্ষাকারী, বেশি বিশ্বস্ত, বেশি সচ্চরিত্রবান, আর মানুষের বেশি কাছে।তিনি বলেন : যখন লম্পট প্রশংসিত হয় তখন আরশ কেঁপে ওঠে আর মহাপ্রতিপালক ক্রুদ্ধ হন।

এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল : হায্ম বা পরিণামদর্শিতা কী? তিনি উত্তরে বললেন : কোনো বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সাথে পরামর্শ করবে ও এরপর তা মেনে চলবে।

একদিন মহানবী (সা.) বললেন : হে লোকেরা তোমাদের মধ্যে আঁটকুড়ে কে? তারা বলল : যে কোনো সন্তান না রেখে মারা যায়। তিনি বললেন : প্রকৃত আঁটকুড়ে হল সেই লোক যে মারা যায়, অথচ এমন সন্তান রেখে যায় নি যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার জন্য সৎ কাজ করবে। যদিও মৃত্যুর পরে তার অনেক সন্তান-সন্ততিও থাকে। এরপর বললেন : তোমাদের মধ্যে নিঃস্ব কে? তারা বলল : যার কোনো সম্পদ নেই। তিনি বললেন : প্রকৃত অর্থে নিঃস্ব হলো সে যে নিজ মাল-সম্পদ থেকে কোনো কিছুই আগে পাঠায়নি যা আল্লাহর কাছে গচ্ছিত থাকবে। যদিও তার পরে অনেক মাল-সম্পদই থেকে যায়।

এরপর বিশ্বনবী (সা.) বললেন : তোমাদের মধ্যে বীর কে? সবাই বলল : যে ব্যক্তি কঠোর এবং শক্তিশালী, কখনো সে ধরাশায়ী হয় না। তিনি বললেন : প্রকৃত অর্থে বীর হলো সেই ব্যক্তি যার মনে শয়তান মুষ্টাঘাত মারে এবং প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয় ও তার রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। এরপর সে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজ শৌর্য দিয়ে রাগ দমন করে।

তিনি বলেন : যে ব্যক্তি না জেনে কাজ করে সে যতটা না ভালো করে তার চেয়ে বেশি খারাপ করে।তিনি আরো বলেন : মসজিদের নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকা ইবাদত যতক্ষণ না কোনো মন্দ করে। বলা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! কি মন্দ করে? তিনি বললেন : পরনিন্দা।

রাসূল (সা.) বলেন : রোজাদার ব্যক্তি ইবাদতের মধ্যে থাকে, এমনকি যদি নিজ বিছানায় ঘুমিয়েও থাকে। যতক্ষণ না সে কোনো মুসলমানের গিবত করে।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: যে অশ্লীলতাকে প্রকাশ করে সে তা সম্পাদনকারীর সমতুল্য, আর যে কোনো মুমিনকে কোনো দোষে দোষারোপ করে সে ততক্ষণ মৃত্যুবরণ করে না যতক্ষণ সে নিজেও সেই দোষের কাজ করে।

তিনি বলেন : তিন ধরনের লোক রয়েছে যাদেরকে তুমি অত্যাচার না করলেও তারা তোমাকে অত্যাচার করবে। নিকৃষ্টরা, তোমার স্ত্রী আর তোমার ভৃত্য। ( উল্লেখ্য, এখানে উদ্দেশ্য হলো এ তিন দল তাদের প্রাপ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হয় না। তাই তাদের বাড়াবাড়ির প্রবণতা থাকে। কিন্তু এর অর্থ এটা নয় যে, তাদের ওপর অত্যাচার জায়েজ। বরং তাদের সাথে মানিয়ে চলতে হবে এবং বৈধভাবে তাদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করতে হবে যেন তারা মানুষকে পেয়ে না বসে।)

মহানবী (সা.) বলেন, হতভাগ্যের লক্ষণ চারটি : চোখের শুষ্কতা বা ক্রন্দনহীনতা, অন্তরের কাঠিন্য, দুনিয়া কামনায় অতিশয় লোভ আর পাপকর্মে পীড়াপীড়ি।এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-কে বলল : আমাকে উপদেশ দিন। তখন তিনি বললেন : রাগ করবে না। পুনরায় সে আবেদন জানালো। তিনি বললেন : রাগ করবে না। এরপর বললেন : বীরত্ব এটা নয় যে, প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করবে। নিশ্চয়ই বীরত্ব হলো রাগের সময় ধৈর্য ধরতে পারা।

বিশ্বনবী (সা.) বলেন : সেই মুমিনই ঈমানে পূর্ণাঙ্গতর যে চরিত্রে বেশি উন্নত বা উত্তম।তিনি বলেন : কোনো বিষয়ে নমনীয়তা মানুষের জন্য অলংকার হয়ে দাঁড়ায় আর কোনো বিষয়ে বেশি কঠোরতা তার জন্য অসুন্দর হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি আরো বলেছেন : পোশাক বিত্তের প্রকাশ করে আর ভৃত্যের প্রতি দয়া শত্রুকে দমন করে। আমি আদিষ্ট হয়েছি মানুষের সাথে মানিয়ে চলতে যেমনভাবে আদিষ্ট হয়েছি রেসালাত প্রচারে। তোমার প্রত্যেক কাজে গোপনীয়তার সাহায্য নাও। কারণ, প্রত্যেক নেয়ামতের অধিকারীকে হিংসা গ্রাস করে।তিনি বলেন : ঈমানের দু’টি ভাগ। অর্ধেক হলো ধৈর্যের মধ্যে আর অর্ধেক কৃতজ্ঞতার মধ্যে।রাসূলে পাক (সা.) আরো বলেন : অঙ্গীকার মেনে চলা ঈমানের অঙ্গ ও বাজারে খাওয়া হীন কাজ।

বিশ্বনবী (সা.) বলেন : সবই প্রার্থনা করো আল্লাহর দরবারে। সেগুলোকে তার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে কায়মনে আল্লাহর কাছ থেকে কামনা করো। এরপর আল্লাহ সেসব থেকে যা কিছু তোমাদেরকে দান করেন, সেগুলোকে ধৈর্যসহ গ্রহণ করো।

তিনি আরো বলেছেন : মুমিনের জন্য বিস্ময় যে, আল্লাহ্ তার জন্য কোনো কিছুই ধার্য করেন না যদি না তা তার জন্য কল্যাণকর হয়, চাই সে খুশী হোক আর চাই অপছন্দ করুক। যদি তাকে বিপদ দেন তা হলে সেটা তার পাপের খণ্ডন আর যদি তাকে কিছু দান করেন এবং সম্মানিত করেন তা হলে এটা তার প্রতি আল্লাহর দান।

রাসূলে পাক বলেন : আমি কি তোমাদেরকে সংবাদ দেব না যে, তোমাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তির চরিত্রের সঙ্গে আমার চরিত্রের বেশি মিল রয়েছে? সবাই বলল : অবশ্যই, হে রাসূলুল্লাহ্! তখন তিনি বললেন : তোমাদের মধ্যে যে অন্যদের চেয়ে বেশি সচ্চরিত্রবান এবং বেশি শৌর্যবান ও নিজ আত্মীয়দের সঙ্গে বেশি সদাচারী, আর যারা সন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ উভয় অবস্থায় নিজের পক্ষ থেকে অন্যদের চেয়ে বেশি মাত্রায় ন্যায়বিচার মেনে চলে।

মহানবী বলেছেন : যে ব্যক্তি খায় এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে নীরব তথা অকৃতজ্ঞ রোজাদারের চেয়ে উত্তম।

রাসূলে পাক বলেছেন : আল্লাহর জন্য মুমিনের সাথে মুমিনের বন্ধুত্ব হলো ঈমানের একটি বড় শাখা। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালোবাসে ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে আর আল্লাহর জন্য দান করে এবং আল্লাহর জন্যই দান থেকে বিরত থাকে সে হলো নির্বাচিত বান্দাদের মধ্যে একজন।

তিনি আরো বলেছেন : আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর বেশি প্রিয় যে তাঁর বান্দাদের জন্য অন্যদের চেয়ে বেশি উপকারী আর বেশি মাত্রায় ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী এবং সদাচার ও সৎকর্মই যার পছন্দনীয় বিষয়।

মহানবী আরো বলেছেন : যে ব্যক্তি নমনীয়তা থেকে বঞ্চিত সে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।মহানবী বলেছেন : মুমিন হলো সদাচারী এবং হাসিখুশি আর মুনাফিক হলো অভদ্র ও রুক্ষ।

আল্লাহর সর্বশেষ নবী বলেছেন: উপহার তিন ধরনের : উপহারের বিনিময়ে উপহার, কৃত্রিম উপহার এবং আল্লাহর জন্য উপহার।তিনি আরো বলেছেন : ধন্য সেই ব্যক্তি যে বর্তমান ভোগ-বিলাসকে পরিহার করে এমন প্রতিশ্রুতির আশায় যা দেখে নি।

এক ব্যক্তি মহানবীকে তাঁর উম্মতের জামায়াতের অর্থ কী তথা ‘সেই দল, আল্লাহর সাহায্য যাদের সাথে রয়েছে, তারা কারা?’- এই প্রশ্ন করলে তার উত্তরে তিনি বলেন: আমার উম্মতের জামায়াত হলো হকপন্থীরা, হোক তারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয়।

বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন : তোমাদের কেমন লাগবে যখন তোমাদের নারীরা নষ্টা হবে, যুবকরা অনাচারী হবে, তোমরা সৎ কাজে আদেশ করবে না এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে না? বলা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! এমন কি হবে? বললেন : হ্যাঁ, এর চেয়েও খারাপ হবে। তোমাদের কেমন লাগবে যখন মন্দের দিকে আদেশ করা হবে আর ভালো থেকে ফিরিয়ে আনা হবে? আরজ করা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! এমন কি হবে? বললেন : হ্যাঁ, এর চেয়েও খারাপ হবে। তোমাদের কেমন লাগবে যখন তোমরা ভালোকে মন্দ আর মন্দকে ভালো বলে বিবেচনা করবে?

তিনি আরো বলেছেন, আমার উম্মত থেকে নয়টি ক্ষেত্রে শাস্তি তুলে নেয়া হয়েছে : ভুল-প্রসূত কর্ম, বিস্মৃতিজনিত কর্ম, এমন বিষয় যা তার ওপর জোর কোরে চাপিয়ে দেয়া হয়, যে বিষয়ে সে জ্ঞান রাখে না, যার সামর্থ্য তার নেই, যে বিষয়ে সে নিরুপায় হয়ে পড়ে, হিংসা যা অপ্রকাশিত রয়েছে ও বাস্তব রূপ লাভ করে নি, অশুভ ভাগ্য পরীক্ষা, আর বিশ্বের স্রস্টা ও সৃষ্টির বিষয়ে প্ররোচনামূলক চিন্তা যতক্ষণ না সেটাকে মুখে ও ভাষায় প্রকাশ করে।

মহানবী (সা.) আরো বলেছেন: যখন আমার উম্মতের মধ্যে দুই শ্রেণী ভালো হয় তখন আমার উম্মত ভালো থাকে, আর যদি তারা খারাপ হয় তা হলে আমার উম্মতও খারাপ থাকে। আরজ করা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! তারা কারা? বললেন : ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদ আর শাসকরা।

মহানবী বলেছেন : বুদ্ধিমত্তায় পূর্ণতম মানুষ হলো তারা, যারা আল্লাহকে বেশি ভয় করে চলে এবং তাঁর আনুগত্য করে। আর বুদ্ধিমত্তায় ত্রুটিপূর্ণতম মানুষ হলো তারা যারা শাসককে বেশি ভয় করে চলে এবং তার আনুগত্য করে।তিনি আরো বলেছেন, তিন শ্রেণীর ব্যক্তির সাথে ওঠাবসা অন্তরকে মেরে ফেলে : বখাটেদের সাথে চলাফেরা, নারীদের সাথে কথা বলা, আর বিত্তবানদের সাথে ঘোরাফেরা করা।

বিশ্বনবী (সা.) বলেন : যখন আল্লাহ্ কোনো উম্মতের ওপর ক্রুদ্ধ হন এবং তাদের ওপর শাস্তি নাজিল করেন, তখন তাদের দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, তাদের আয়ু কমে যায়, তাদের ব্যবসায় লাভ হয় না, তাদের ফলমূল ভালো হয় না, তাদের নদী-নালাগুলো পানিতে পূর্ণ থাকে না, তাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয় না, এবং তাদের দুষ্টরা তাদের ওপর কর্তৃত্বশীল হয়।

মহানবী (সা.) আরো বলেছেন : যখন আমার পরে ব্যভিচার বেড়ে যাবে তখন আকস্মিক মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে যাবে। আর যখন ওজনে কম দেয়া হবে তখন আল্লাহ্ তাদের দুর্ভিক্ষ ও অনটনের শিকার করবেন, আর যখন যাকাত দেয়া হবে হবে না, তখন মাটি চাষাবাদ, ফসলাদি এবং খনিজ থেকে কল্যাণ দানে কার্পণ্য করবে, আর যখন বিচারে অন্যায় রায় প্রদান করবে তখন তারা অত্যাচার ও শত্রুতায় পরস্পরের সহযোগী হবে, আর যখন চুক্তিভঙ্গ করবে তখন আল্লাহ্ শত্রুদেরকে তাদের ওপর কর্তৃত্বশীল করবেন। আর যখন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে তখন মাল-সম্পদ দুষ্টদের হাতে পড়বে। আর যখন সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্ব পালন করবে না এবং আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে পুণ্যবানদের অনুসরণ করবে না তখন আল্লাহ্ তাদের থেকে দুষ্টদেরকে তাদের ওপর ক্ষমতাসীন করে দেবেন। তখন তাদের মধ্যে সৎ লোকেরা দোয়া করলেও তাতে জবাব বা সাড়া পাবে না।

আর যে ব্যক্তি অন্য লোকের হাতে দুনিয়ার যা কিছু রয়েছে সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয় তার দুঃখ দীর্ঘায়িত হয় এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তার জন্য যে রুজি বরাদ্দ রেখেছেন তাতে অসন্তোষ দেখায়, জীবন তার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। আর যে ব্যক্তি খাদ্য ও পানীয় ছাড়া তার ক্ষেত্রে আল্লাহর অন্য কোন নেয়ামতকে দেখতে পায় না, সে নির্ঘাত মূর্খ এবং আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করেছে। তার চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ আর তার শাস্তি আসন্ন।

রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন : মুসলমান না হয়ে কেউই বেহেশতে প্রবেশ করবে না। তখন হযরত আবু যর (রা.) বললেন : হে রাসূলুল্লাহ্! ইসলাম কী? তিনি বললেন : ইসলামের পোশাক হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি। তার বাইরের আবরণ হলো হেদায়েত। আর তার ভেতরের আবরণ হলো লজ্জা। আর তার মাপকাঠি হলো সংযমশীলতা, আর তার পূর্ণাঙ্গতা হলো দীন বা ধর্ম আর তার ফল হলো সৎ কাজ। আর প্রত্যেক জিনিসের একটি ভিত থাকে। ইসলামের ভিত হলো আমার আহলে বাইত (আ.)-কে ভালোবাসা।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের মধ্যে কিছু বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের উপকারের জন্য। তারা পরোপকারে তৃপ্তি লাভ করে এবং দানশীলতাকে মহৎ কাজ বলে মনে করে। আর আল্লাহ্ উত্তম চরিত্রকে পছন্দ করেন।

তিনি আরো বলেছেন: নিশ্চয় আল্লাহর কিছু বান্দা রয়েছে মানুষ বিপদ-আপদে যাদের শরণাপন্ন হয়। এরাই হলো তারা যারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আযাব থেকে নিরাপদ থাকবে।

মহানবী বলেছেন : নিশ্চয় মুমিন আল্লাহর শিষ্টাচারকে ধারণ করে। যখন আল্লাহ তাকে প্রশস্ততা দান করেন তখন সে প্রশস্ত হস্ত আর যখন তাকে সংকীর্ণতায় রাখেন সেও তখন নিবৃত্ত থাকে।

আল্লাহর সর্বশেষ রাসুল বলেছেন : মানুষের জন্য এমন এক সময় আসবে যখন তার ধর্মে কতোটা ক্ষতি হলো এ বিষয়ে সে কোনো পরোয়া করবে না যদি তার দুনিয়া ঠিক থাকে।

মহানবী (সা.) আরো বলেন : যে আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে সদাচার করে তাদের তথা বান্দাহদের অন্তরে আল্লাহ ওই ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি করেন আর যে তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে আল্লাহ তার জন্য বান্দাহদের মধ্যে ঘৃণা জন্ম দেন। আল্লাহ এই স্বভাব দিয়েই মানুষ সৃষ্টি করেছেন।

মহানবী আরো বলেছেন: যখন আমার উম্মত পনেরটি কাজ করে তখন তারা বিপদগ্রস্ত হয়: যখন গনিমতকে নিজেদের (একদলের) মধ্যে হাত বদল করবে (এবং তা থেকে সম্পদ জমা করবে), আমানতকে গনিমত হিসেবে গ্রহণ করবে (এবং নিজের অধিকারভুক্ত করে নেবে), যাকাত দেয়াকে ক্ষতি বলে মনে করবে, পুরুষ নিজ স্ত্রীর অনুসারী হবে, তার মায়ের সঙ্গে অবিচার করবে, বন্ধু বা সঙ্গীর উপকার করলেও নিজ পিতার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করবে, মসজিদগুলোয় উচ্চস্বরে আওয়াজ করবে, কোনো ব্যক্তিকে তার অনিষ্টতা থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যেই সম্মান করবে, সম্প্রদায়ের নেতা হবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি, রেশমি কাপড় পরবে, মদপান করবে ও বাইজী বা গায়িকার দল পুষবে এবং উম্মতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পূর্ববর্তীদেরকে অভিশম্পাত দেবে। আর এ অবস্থায় তিনটি ঘটনার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে : লোহিত ঝড় বা রক্তের ঝড়, দৈহিক রূপান্তর ও সামাজিক নৈরাজ্য।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য জেলখানা আর কাফেরের জন্য বেহেশত।

তিনি আরো বলেন : মানুষের জন্য এমন এক সময় আসবে যখন মানুষ হবে নেকড়ে। আর যে নেকড়ে না হবে তাকে অন্য নেকড়েরা খেয়ে ফেলবে।রাসূল (সা.) বলেন : শেষ জামানায় সবচেয়ে কম যে জিনিস থাকবে তা হলো বিশ্বস্ত ভাই, আর হালাল অর্থ।মহানবী বলেন : মানুষ সম্পর্কে কুধারণা থেকে দূরে থেকো।

বিশ্বনবীর সামনেই একদল লোক জনৈক ব্যক্তির ভূয়সী প্রশংসা করলো। এমনকি তারা সমস্ত গুণের কথা তার জন্য উল্লেখ করলো। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন : লোকটির বুদ্ধিমত্তা কেমন? তারা বলল : হে রাসূলুল্লাহ্! আমরা তাঁর ইবাদত ও সৎ কাজের পেছনে তার অবিশ্রান্ত চেষ্টার কথা আপনাকে জানাচ্ছি আর আপনি তার বুদ্ধিমত্তার কথা জানতে চেয়েছেন? তিনি বললেন : বুদ্ধিহীন লোক তার বোকামির কারণে লম্পটের লাম্পট্যের চেয়েও বড় অপকর্মের কবলে পড়ে আর কাল কিয়ামতে লোকেরা তাদের বুদ্ধিমত্তার অনুপাতে মর্যাদা লাভ করবে এবং নিজ প্রতিপালকের নৈকট্য অর্জন করবে।

মহানবী (সা.) বলেছেন : আল্লাহ বুদ্ধিমত্তাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যার মধ্যে সেগুলোর সব কয়টি থাকে তার বুদ্ধিমত্তা পূর্ণতা লাভ করে। আর যার মধ্যে সেগুলোর কোনোটিই নেই তার বুদ্ধিমত্তা নেই। আর সেই তিনটি দিক হল : আল্লাহকে ভালো মতো জানা, আল্লাহকে ভালোমতো আনুগত্য করা আর আল্লাহর কাজে ভালো মতো ধৈর্য ধারণ করা।

মহানবী আরো বলেন : নাজরানের জনৈক খ্রিষ্টান মদীনায় আসল, সে ছিল স্পষ্টভাষী, প্রতিভাবান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আরজ করা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! এ খ্রিস্টান লোকটির কি বুদ্ধিমত্তা রয়েছে? রাসূলুল্লাহ্ (সা.) প্রশ্নকারীকে থামিয়ে দিলেন এবং বললেন : চুপ থাকো। প্রকৃত বুদ্ধিমান হলো সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে এক বলে জানে এবং তাঁর আনুগত্য করে।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন: জ্ঞান মুমিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অধ্যবসায় তার সহযোগী, আর বুদ্ধিমত্তা তার দিশারি, ধৈর্য তার সেনাদলের সেনাপতি এবং মমতা তার পিতা ও পুণ্যকর্ম তার ভাইয়ের মত। আদম (আ.) থেকেই বংশ আর তাকওয়া বা খোদাভীতি হচ্ছে মানুষের (আসল) পরিচয়। আর পৌরুষত্ব হলো সম্পদের পরিশুদ্ধি।#

মহানবী(সা.) বলেন : পরস্পর করমর্দন করো। কারণ, করমর্দন (পারস্পরিক) বিদ্বেষ দূর করে।

তিনি বলেন : মুমিন যে কোনো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারে তবে কখনোই মিথ্যা ও বিশ্বাসঘাতকতার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে থাকতে পারে না।তিনি আরো বলেন : নিশ্চয় কিছু কিছু কবিতায় প্রজ্ঞা রয়েছে, বর্ণনান্তরে কিছু কিছু কবিতা হলো প্রজ্ঞা। আর কিছু কিছু বক্তৃতা যাদুর প্রভাবসম্পন্ন।মহানবী আবু যারকে বললেন : ঈমানের কোন্ রশিটি বেশি শক্ত? তিনি বললেন : আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন : আল্লাহর জন্য বন্ধুত্ব করা, আল্লাহর জন্য শত্রুতা করা আর আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ পোষণ করা।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : মানব জাতির জন্য কল্যাণকর হলো আল্লাহর কাছ থেকে মঙ্গল কামনা করা আর আল্লাহ্ যা কিছু নির্ধারণ করেছেন তাতে সন্তুষ্ট থাকা আর মানব জাতির জন্য দুর্ভাগ্য হলো আল্লাহর কাছ থেকে মঙ্গল কামনা বর্জন করা আর আল্লাহ্ যা কিছু নির্ধারণ করেছেন তাকে মন্দ জ্ঞান করা।মহান আল্লাহর সর্বশেষ রাসূল বলেছেন : অনুতাপ নিজেই তওবা।

বিশ্বনবী বলেন : সেই ব্যক্তি কোরআনে ঈমান আনে নি যে হারামকে হালাল গণ্য করে।

এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে বলল : আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন : তোমার জিহ্বাকে রক্ষা করো। অতঃপর ওই ব্যক্তি বলল : হে রাসূলুল্লাহ্! আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন : তোমার জিহ্বাকে রক্ষা করো। পুনরায় সে বলল : হে রাসূলুল্লাহ্! আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন : আক্ষেপ তোমার ওপর! লোকেরা তাদের জিহ্বা দ্বারা যা কিছু ফসল তোলে তা ছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে কি দোযখে নিক্ষিপ্ত হয়?

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : ভালো কাজগুলো মন্দ মৃত্যু থেকে রক্ষা করে আর গোপনে দান আল্লাহর ক্রোধকে প্রশমিত করে। আর আত্মীয়তার সম্পর্ককে জোড়া লাগানো আয়ু বাড়িয়ে দেয়। আর প্রত্যেক সদাচারই হলো সাদাকাহ্। আর দুনিয়ার সদাচারী ব্যক্তি পরকালে সদাচার লাভের যোগ্য। আর যে দুনিয়ায় খারাপ কাজ করে সে পরকালে মন্দ লাভ করার যোগ্য। আর সদাচারীরাই সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করবে।

রাসূলে পাক বলেছেন : নিশ্চয় আল্লাহ্ যখন তাঁর বান্দাকে নেয়ামত দান করেন তখন তার ওপর সে নেয়ামতের প্রভাবকে দেখতে পছন্দ করেন। আর জীবনকে মন্দ করা ও মন্দভাবে জীবন যাপন করাকে ঘৃণা করেন।

বিশ্বনবী আরো বলেছেন : উত্তম প্রশ্ন হলো জ্ঞানের অর্ধেক। আর নমনীয়তা তথা অন্যের সাথে মানিয়ে চলা হলো জীবিকার অর্ধেক।মহানবী (সা.) বলেন : আদম সন্তানরা বৃদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তার মধ্যে দু’টি জিনিস যৌবন লাভ করে : লোভ ও উচ্চাশা।তিনি আরো বলেন : লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখন কোনো বান্দারই পা সরবে না যতক্ষণ না তাকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে : তার আয়ুষ্কাল সম্পর্কে তা কোন্ পথে নিঃশেষ করেছে, তার যৌবন সম্পর্কে তা কোন্ কাজে পরীক্ষা করেছে, তার আয়-উপার্জন সম্পর্কে তা কোন্ পথে অর্জন করেছে এবং কোন্ কাজে ব্যয় করেছে আর আমার আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে।

রাসূলে পাক বলেন : যে ব্যক্তি মানুষের সাথে লেনদেন করে অথচ তাদের সঙ্গে অন্যায় বা অবিচার করে না ; তাদের সাথে কথা বলে তবে মিথ্যাচার করে না ; তাদের সাথে অঙ্গীকার করে তবে তা ভঙ্গ করে না- সে হলো এমন ব্যক্তি যার পৌরুষত্ব পূর্ণতা পেয়েছে এবং তার ন্যায়পরায়ণতা প্রকাশ পেয়েছে ও তার প্রতিদান অপরিহার্য হয়েছে আর তার গীবত করা নিষিদ্ধ হয়েছে।

তিনি আরো বলেন : মুমিনের আপাদমস্তক সম্মানীয় : তাঁর সম্ভ্রম, তাঁর মাল-সম্পদ এবং তাঁর রক্ত।মহানবী (সা.) বলেন : তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ককে জোড়া লাগাও যদি তা সালাম দেয়ার মাধ্যমেও হয়।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন : ঈমান হলো অন্তরে বিশ্বাস করা, জিহ্বা দিয়ে ব্যক্ত করা, আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে পালন করা।মহানবী বলেন : প্রাচুর্য বেশি মাল-সম্পদের অধিকারী হওয়ার মধ্যে নেই, বরং তা রয়েছে মনের অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে।তিনি বলেন : মন্দ করা থেকে বিরত থাকাই সদ্কাস্বরূপ।

তিনি আরো বলেন : চারটি জিনিস রয়েছে যা আমার প্রত্যেক হৃদয়বান বুদ্ধিমান উম্মতের জন্য আবশ্যক। আরজ করা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! সেগুলো কী কী? তিনি বললেন : জ্ঞান শ্রবণ করা, তা রক্ষা করা, তা প্রচার করা এবং তা মেনে চলা।

রাসূলে পাক (সা.) বলেন : নিশ্চয় কিছু কিছু বক্তৃতা হলো যাদু আর কিছু কিছু জ্ঞান হলো অজ্ঞতা আর কিছু কিছু কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

বিশ্বনবী (সা.) বলেন : প্রথা হলো দু’টি। একটি প্রথা হলো যা কাজে লাগানো জরুরি এবং আমার পরে তা আমল করা হেদায়েত ও তা বর্জন করা পথভ্রষ্টতার নামান্তর। আরেক প্রথা হলো যা জরুরি নয়, তবে তা কাজে লাগানো মর্যাদাকর এবং তা বর্জন করা গুনাহ নয়।

তিনি আরো বলেন : যে ব্যক্তি আল্লাহকে রাগিয়ে শাসককে সন্তুষ্ট করে সে আল্লাহর দীন বা ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছে।

আর আল্লাহ দুনিয়া-প্রেমিকের আশা প্রলম্বিত করেন ও দুনিয়া-প্রেমের অনুপাতে তার অন্তরকে অন্ধ করেন। আর যে দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত থাকে ও দুনিয়াবি আশাকে খাটো করে আল্লাহ্ তাকে তার অনর্জিত জ্ঞানগুলো শিক্ষা দান করেন এবং কোনো পথ নির্দেশক ছাড়াই তাকে সুপথ দেখান। আর তার অন্তরের অন্ধত্বকে দূর করেন ও তাকে দৃষ্টিবান করেন। জেনে রাখ, আমার পরে এমন লোকেরা থাকবে যারা শাসন-কর্তৃত্ব ও রাষ্ট্র চালাতে পারবে না হত্যাকাণ্ড ও স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া। তাদের ধন-সম্পদে প্রাচুর্য হবে না কৃপণতা ছাড়া; তারা মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হবে না রিপু ও কামনার দাসত্ব এবং ধর্মে অবহেলা প্রদর্শন করা ছাড়া। তাই যে এমন যুগ দেখবে সে যেন অভাবে, অখ্যাতিতে ও মানুষের ঘৃণায় ধৈর্য ধারণ করে যদিও ধনী, খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় হওয়ার সামর্থ্য সে রাখে। আর এ কাজে তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ্ তাকে পরকালে পঞ্চাশ জন সিদ্দিকের বা সত্যবাদীর পুরস্কার দান করবেন।

মহানবী (সা.) বলেছেন : তোমরা মুনাফিকের মত বিনয় প্রদর্শন করবে না; আর সেটা হলো যখন শরীর বিনয়ী হয় কিন্তু অন্তরে বিনয় নেই।তিনি বলেছেন : নিন্দিত সৎকর্মশীল ব্যক্তি অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয়।

তিনি আরো বলেন : অনুগ্রহকে গ্রহণ করো। আরো সর্বোৎকৃষ্ট অনুগ্রহ হলো সুগন্ধি যা সহজে বহনীয় এবং সুঘ্রাণযুক্ত।

বিশ্বনবী (সা.)বলেছেন : ধার্মিক অথবা সম্ভ্রান্তকে অবশ্যই সদাচার করতে হবে। আর অক্ষমদের জিহাদ হলো হজ্ব। আর স্ত্রীর জিহাদ হলো খুব ভালোভাবে স্বামীর সেবা করা। আর দয়াশীলতা হলো ধর্ম বা দীনের অর্ধেক। আর যে ব্যক্তি হিসাব মতো খরচ করে চলে সে কখনো নিঃস্ব হয় না। আর সাদাকাহ্ দেয়ার মাধ্যমে রিজিক নামিয়ে আনো।

মহান আল্লাহর শেষ রাসূল বলেছেন : কোনো বান্দাই মুত্তাকীনদের মর্যাদায় পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না এমন সব হালালকেও পরিহার করবে যাতে দূষণীয় ও হারাম বিষয়ে পতিত হওয়া থেকে বাঁচতে পারে।

রাসূল (সা.)’র মুচকি হাসি

একদিন রাসূল (সা.) আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। এক ব্যক্তি হযরতকে বললেন,“ ইয়া রাসূলাল্লাহ আপনার হাসির কারণ কি?” রাসূল (সা.) বললেন,“ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুইজন ফেরেশতা প্রতিদিন আল্লাহর ইবাদতকারী এক ব্যক্তির পুরষ্কার দিতে পৃথিবীতে এসেছেন। কিন্তু তারা দেখল সেই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। ফেরেশতারা আল্লাহকে বলল,“ আমরা প্রতিদিনের মত ঐ ঈমানদার ব্যক্তির ইবাদতের স্থানে আজও গিয়েছিলাম, কিন্তু তাকে আজ সেখানে পেলাম না কেননা সে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে।” আল্লাহ ফেরেশতাদেরকে বললেন,“ সে যতদিন অসুস্থ থাকে তার সওয়াবকে আগের মতই লিখতে থাক। তার অসুস্থতা অব্যাহত থাকা পর্যন্ত তার নেক আমলের পুরষ্কার দেয়া আমার কর্তব্য।”

(পালাক্রম মেনে চলো)

একদিন রাসূল (সা.) যখন বিশ্রাম করছিলেন এ অবস্থায় শিশু ইমাম হাসান (আ.) তাঁর কাছে পানি চাইলেন। রাসূল (সাঃ) এক পেয়ালা দুধ নিয়ে ইমাম হাসানের দিকে বাড়িয়ে দিলেন, তখন শিশু ইমাম হুসাইনও পেয়ালাটি নেয়ার জন্য এগিয়ে এলেন কিন্তু রাসূল (সাঃ) দুধের পেয়ালাটি হুসাইনকে না দিয়ে হাসানকেই দিলেন। হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.) বিষয়টি দেখে রাসূল (সা.)এর কাছে প্রশ্ন করলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ(সা.) আপনি কি হাসানকে বেশী ভালবাসেন?” রাসূল (সা.) বললেন, “এমনটি নয় আমি তাদের দুজনকেই সমান ভালবাসি; তবে হাসান যেহেতু আগে চেয়েছে তাই তাকে আগে দেওয়াটাই কর্তব্য।”

(রাসূল (সা.)’র ক্রন্দন)

এক রাত্রে রাসূল (সা.) নিজের স্ত্রী উম্মে সালামা (সালামুল্লাহি আলাইহা)’র ঘরে ছিলেন। বিশ্বনবী মধ্য রাতে উঠে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে দোয়া করছিলেন এবং কাঁদছিলেন।

উম্মে সালামা শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন রাসূল (সা.) ঘরের এক কোণে দাড়িয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে কাঁদছেন এবং বলছেন,“ হে আল্লাহ, যেসব নেয়ামত আমাকে দিয়েছেন তা আমার থেকে উঠিয়ে নিবেন না!”

হে আল্লাহ, আমাকে দুশমনদের তিরষ্কার থেকে রক্ষা করুন এবং যারা আমাকে হিংসা করে তাদেরকে আমার উপর আধিপত্য দিবেন না ! হে আল্লাহ, যেসব গোনাহ থেকে আমাকে মুক্ত রেখেছেন কখনোই আমাকে সে গোনাহে পতিত করবেন না !হে আল্লাহ কখনোই আমাকে আমার উপর ছেড়ে দিবেন না এবং আপনিই আমাকে সকল দুর্বিপাক হতে রক্ষা করুন !

উম্মে সালামা রাসূল (সা.) এর এ দোয়া শুনে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ফিরে গেলেন। রাসূল (সা.)বললেন,“ কাঁদছ কেন উম্মে সালামা?” উম্মে সালামা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, কিভাবে না কেঁদে পারি! আপনি এত বেশী মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্তেও যেভাবে আল্লাহর দরবারে রোনাজারী করছেন এবং তাঁর কাছে চাইছেন যে যেন তিনি আপনাকে এক মুহূর্তের জন্যেও আপনার নিজের উপর ছেড়ে না দেন। তাহলে আমাদের অবস্থাতো খুবই শোচনীয়!”

রাসূল (সা.) বললেন,“ কেন ভয় করব না, কেন কাঁদব না, কেনইবা আমার শেষ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তিত থাকব না আর কিভাবেই বা আমার মর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকব?! আল্লাহপাক হযরত ইউনুসকে এক মুহূর্তের জন্যে এই নবীর নিজের ওপর ছেড়ে দেয়ায় কি কঠিন বিপদই না তার উপর নেমে এসেছিল!”

রাসূল (সা.) বললেন, “সাদের মাতা! চুপ কর। এত দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে কথা বল না। এখন কবরে সাদের উপর আযাব হচ্ছে এবং সে কষ্ট পাচ্ছে।” অতঃপর কবরস্থান থেকে ফিরে এলেন।

সাহাবিরা প্রশ্ন করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি সাদের জানাজার নামাজ পড়ালেন, নিজ হাতে কবরে শোয়ালেন এবং নিজেই তার কবর বানালেন; তার পরও বলছেন কবরে তার ওপর আযাব হচ্ছে?” রাসূল (সা.) বললেন, “হ্যাঁ! সাদ তার পরিবারের (স্ত্রীর) সাথে খারাপ আচরণ করত এবং একারণেই কবরে তার উপর আযাব হচ্ছে।”

এক ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর কাছে এসে দেখল তিনি একটি পুরাতন পোশাক পরে আছেন। লোকটি কাজ সেরে যাওয়ার সময় রাসূলকে (সা.) অনুরোধ করে বলল, “হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনি এই বার দেরহাম হাদিয়া হিসাবে গ্রহণ করে একটি নতুন পোশাক কিনুন” রাসুল (সা.) আলীকে (আ.)বললেন,“ টাকাটা নিয়ে আমার জন্য একটা জামা কিনে নিয়ে এস।”

আলী (আ.) বলেন,“ আমি টাকাটা নিয়ে বাজারে গিয়ে বার দেরহাম দিয়ে একটা জামা কিনে আনলাম।” রাসূল (সা.) জামাটা দেখে বললেন,“আমার এটা পছন্দ হচ্ছে না একটা কম দামী জামা নিয়ে এস।”

আলী (আ.) বলেন, “আমি দোকানে গিয়ে জামাটা ফিরিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে রাসূল (সাঃ) এর কাছে এলাম। অতঃপর জামা কেনার জন্য রাসূল (সাঃ) এর সাথে বাজারের উদ্দেশ্যে বের হলাম।” পথে রাসূল (সা.) একজন দাসীকে কাঁদতে দেখলেন। রাসূল (সা.) তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,“কাঁদছ কেন?” দাসী বলল, “মনিব বাজার করার জন্য আমাকে চার দেরহাম দিয়েছিল কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি এখন বাসায় ফিরতে ভয় পাচ্ছি।”রাসূল (সা.) বার দেরহাম থেকে চার দেরহাম দাসীটিকে দিয়ে বললেন, “যা কেনার কিনে নিয়ে বাসায় যাও। আমরাও বাজারে গেলাম রাসূল (সা.) চার দেরহাম দিয়ে একটি জামা কিনে পরলেন।”

ফিরে আসার সময় রাসূল (সা.) একটি লোককে দেখলেন যার জামা ছিল না। রাসূল (সা.) জামাটি খুলে লোকটিকে দিয়ে আবার বাজারে গিয়ে বাকি চার দেরহাম দিয়ে আরো একটি জামা কিনে পরে বাড়ির দিকে রওনা হন। পথে আবার সেই দাসীটিকে দেখলেন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বসে আছে। এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় দাসীটি বলল,“হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমার দেরী হয়ে গেছে তাই ভয় করছে, বাসায় গেলে আমাকে মারধর করবে।” রাসূল (সা.) তার জন্য সুপারিশ করার প্রতিশ্রুতি দেন। রাসূল (সা.) দাসীসহ বাড়ির মালিকের বাড়িতে গিয়ে তাকে সালাম করলেন কিন্তু জবাব এল না। তৃতীয়বার সালামের পর জবাব শোনা গেল- ওয়া আলাইকুম আসসালাম ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.)। রাসূল (সা.) বললেন, “কেন প্রথমে জবাব দিলে না?” বাড়ির কর্তা বলল,“আপনার সালামকে বারবার শোনার জন্য।” রাসূল (সাঃ) বললেন,“ তোমার দাসী দেরি করেছে আমি তাকে সাথে নিয়ে এসেছি তুমি তাকে কিছু বল না।” বাড়ির কর্তা বলল,“ হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনার জন্যে এই দাসীকে মুক্ত করে দিলাম।” এরপর রাসূল (সা.) নিজে নিজে বললেন,“এই বার দেরহাম খুবই বরকতময় ছিল। যার বিনিময়ে দুইজন জামা পরিধান করল এবং একজন দাসী মুক্তি পেল।”

এক ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, “আমাকে কিছু উপদেশ দান করুন।” হযরত তাকে এভাবে উপদেশ দিলেন, “আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যদি তোমাকে কেউ নির্যাতন করে এমনকি যদি তোমাকে আগুনেও পোড়ায় তার পরও তুমি শিরক কোরো না। বাবা-মাকে কষ্ট দিও না এবং তাদের সাথে ভাল আচরণ করো তাদের জীবিত অবস্থায় ও মৃত্যুর পর। তাদের আদেশ মেনে চল। যদি বলে যে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও, তাই কর। কারণ তা হচ্ছে ঈমানের নিদর্শন। কিছু অবশিষ্ট থাকলে তোমার মোমিন ভাইকে দান কর। দ্বীনি ভাইদের সাথে হাসি মুখে ভাল আচরণ কর। মানুষকে হেয় কর না, তাদের প্রতি দয়ালু হও। কোন মুসলমানকে দেখলে সালাম করবে। মানুষকে সঠিক ইসলামের পথে আহবান কর। জেনে রাখ, কারও উপকার করলে একজন গোলাম মুক্ত করার সমান সওয়াব পাবে ! জেনে রাখ, মদসহ সব নেশাজাতীয় দ্রব্য হারাম।

একবার রাসূল (সা.) সাথীদেরকে নিয়ে বসেছিলেন। হঠাৎ করে হেসে উঠলেন। সাহাবারা রাসূল (সা.) এর হাসির কারণ জানতে চাইলে রাসূল (সা.) বললেন,“আমার উম্মতের দুই ব্যক্তি আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে একজন আর একজনকে দেখিয়ে বলবে: হে আল্লাহ আমার অধিকারকে ওর কাছ থেকে আদায় করে দিন!” আল্লাহ বলবেন, “তোমার ভাইয়ের অধিকার দিয়ে দাও !”

সে বলবে, “হে আল্লাহ আমার ভালো আমল বলতে কিছুই নেই আর পার্থিব সম্পদও আমার নেই।” তখন হকদার বলবে, “হে আল্লাহ এমতাবস্থায় আমার গোনাহগুলোকে তার উপর চাপিয়ে দিন !”

এ পর্যন্ত বলার পর রাসূল (সা.) এর চোখ মোবারক থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল। তিনি বললেন, “সেদিন মানুষ তার গোনাহ’র বোঝা বহনের জন্য অন্যের সাহায্য চাইবে। সেদিন যে ব্যক্তি তার অধিকার চাইবে আল্লাহ তাকে বলবেন, “চোখ ফিরাও এবং বেহেশতের দিকে তাকাও, কি দেখছ? তখন সে বেহেশতের অফুরন্ত নেয়ামত দেখে অবাক হয়ে বলবে,“হে আল্লাহ এসব কাদের জন্য?”

আল্লাহ বলবেন, “বেহেশতের এইসব অফুরন্ত নেয়ামত তার জন্য যে তার মূল্য আমাকে দিতে পারবে?”সে বলবে, “কে পারবে তার মূল্য দিতে?”আল্লাহ বলবেন, “তুমি।”সে বলবে, “হে আল্লাহ কিভাবে তা সম্ভব?” আল্লাহ বলবেন, “যদি তুমি তোমার দ্বীনি ভাইকে ক্ষমা কর।”সে বলবে, “হে আল্লাহ আমি তাকে ক্ষমা করলাম।”

অতঃপর আল্লাহ বলবেন, “তোমার দ্বীনি ভাইয়ের হাত ধরে বেহেশতে প্রবেশ কর।” এরপর রাসূল (সা.) বললেন, “তাকওয়া অর্জন কর এবং নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধান কর !”

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এইসব অমূল্য বাণী মেনে চলার তাওফিক দিন। আমিন।

[সুত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার : “তুহাফুল উকুল আন আলের রাসূল (সা.)”,”আলে রাসূল (সা.) থেকে বুদ্ধিমানদের জন্য উপহার”। মূল: শেখ আবি মুহাম্মাদ আল হাসান ইবনে আলী ইবনেল হুসাইন ইবনে শুবাত আল-হাররানি (রহ.), হিজরী চতুর্থ শতকের প্রখ্যাত পণ্ডিত। বঙ্গানুবাদ: আব্দুল কুদ্দুস বাদশা, সম্পাদনা : এ কে এম আনোয়ারুল কবির। শেষের দিকে (উনিশতম পর্বের কয়েকটি ঘটনা ও বিশতম পর্বের সবগুলো ঘটনা)  উল্লেখিত বিশ্বনবী (সা.)’র জীবনের কয়েকটি ঘটনা নেয়া হয়েছে আল্লামা মাজলিসি (র.)’র “বিহারুল আনওয়ার কাহিনী সম্ভার” শীর্ষক বই থেকে। বইটির অনুবাদক মোহাম্মাদ আলী মোর্তজা, সম্পাদনা : এ কে এম আনোয়ারুল কবির। ]

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *