পরামর্শ বা মতবিনিময় সামষ্টিক জীবনের একটি চিরাচরিত রীতি ও প্রচলিত পন্থা যা একটি যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি হিসাবেও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। মানুষের সামাজিক ও জীবন ব্যবস্থাপনায় পরামর্শ সবসময়ই অবিচ্ছেদ্য হয়ে আসছে। এমনকি অত্যন্ত স্বৈরতান্ত্রিক শাসকবর্গও সময়ে সময়ে জনসাধারণকে তুষ্ট ও শান্ত করতে এবং নিজেদের স্বেচ্ছাচার ও একগুঁয়ে মনোভাবজনিত ভুলভ্রান্তি হ্রাস করার জন্য পরামর্শের ব্যবস্থা করে থাকে।
মানবেতিহাসে অভিজ্ঞ ও বিজ্ঞজনদের সাথে পরামর্শ ও মতবিনিময় কেবল সামষ্টিক জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অন্যের সুষ্ঠু মত ও চিন্তা থেকে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশায় মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবন যাপনেও পরামর্শের নীতি অনুসরণ করে থাকে। মানবসমাজ যখন এককেন্দ্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে ইতিহাসে তখন থেকে পরামর্শ বা মতবিনিময়ের ক্ষেত্রে এক বিরাট অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। ইসলাম অপরাপর জাতির গঠনমূলক ও ইতিবাচক রীতিপ্রথার প্রতি অনুমোদন দিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ও সৃষ্টিশীল সামাজিক নিয়ম-কানুনকে গ্রহণ ও সংরক্ষণের ব্যাপারেও গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাই এই খোদায়ী ধর্ম পরামর্শ ও মতবিনিময়ের নীতিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি যৌক্তিক পদ্ধতি এবং কল্যাণকর সামজিক রীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে।
ইসলামী সরকার একটি খোদায়ী ও অন্যদিকে একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান যা ধর্মনিষ্ঠ লোকদের কথোপকথন বা মতবিনিময়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। কোন বিশেষ শ্রেণি বা গ্রুপের প্রাধান্য এর প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং এই সরকার স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ এক বিকল্প ব্যবস্থা। সে কারণে ইসলামী সরকার তার সকল রাজনৈতিক ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের সুব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষকে ক্রমবিকাশের পথে চলতে সহায়তা করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা। সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে সকল ও ব্যাপক মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে এই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে না। তাই ইসলামী সরকার কোন অবস্থাতেই পরামর্শ বা মতবিনিময়ের নীতিকে পাশ কাটিয়ে যায় না; বরং একে একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলা অপরিহার্য বলে মনে করে।
ইসলামী জীবনাদর্শের উৎস কুরআন ও সুন্নায় সমাজের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরামর্শের নীতিকে অতিশয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং একে অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ইসলামী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ও অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনাকালে পবিত্র কুরআনে পরামর্শের নীতি চর্চার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঈমানভিত্তিক একটি ইসলামী সমাজে পরামর্শ অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ প্রসঙ্গে সূরা শুরার ৩৮ ও ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে এবং যারা অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করে…।’
অন্য এক উপলক্ষে পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-কে মুসলমানদের সাথে পরামর্শের মাধ্যমে সামাজিক বিষয় পরিচালনার একটি নির্দেশাত্মক আহ্বান জানিয়েছে। কুরআন নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে এবং পরামর্শকে সাফল্যের চাবিকাঠি আখ্যায়িত করে সহযোদ্ধা ও স্বধর্ম অনুসারীদের সাথে পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বলেছে। সূরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘আল্লাহর দয়ায় তুমি তাদের প্রতি কোমলহৃদয় হয়েছিলে, যদি তুমি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতে তবে তারা তোমার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। সুতরাং তুমি তাদেরকে ক্ষমা কর, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।’
অন্যদের সাথে পরামর্শ করা ছিল মহানবী (সা.)-এর একটি স্থায়ী নীতি। উল্লেখ্য যে, মহানবীর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, কথা ও কাজের মধ্যে ঝকঝকে আয়নার মতো কুরআনই প্রতিবিম্বিত হয়েছে এবং তাঁর জীবনাচারের মধ্য দিয়ে খোদায়ী হুকুম ও কুরআনী নীতিমালা প্রকাশিত ও মূর্ত হয়েছে।
মহানবী (সা.) যেসব উপলক্ষে সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন, যেমন বদর, খন্দক এবং তায়েফের লোকদের সঙ্গে চুক্তিস্বাক্ষর প্রভৃতি- সেসবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া আমরা প্রয়োজন বোধ করছি না। ইসলামের ইতিহাসের কোন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর কর্তৃক পরামর্শের নীতি অনুসরণ এবং তার প্রতি গুরুত্ব আরোপের বিষয়ে কোন প্রশ্ন তোলেননি।
ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও একনায়কতান্ত্রিকতা প্রত্যাখ্যান এবং পরামর্শের নীতি অনুসরণের তাগিদ সম্বলিত বহু হাদীস ও বাণী সংকলিত হয়েছে। সেগুলোর কয়েকটি নিম্নরূপ :
১. পরামর্শকারীরাই আস্থাভাজন।- আবু দাউদ
২. পরামর্শের সময় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তোমার মত ব্যক্ত কর।- ইবনে মাজা
৩. হে আলী! আল্লাহর কাছে ভালোর প্রত্যাশী কেউ বিপথে পরিচালিত হয় না এবং মতবিনিময়ের সময় যারা সৎ পরামর্শ করে তাদের অনুতাপ করতে হয় না।- বিহারুল আনওয়ার
৪. আল্লাহর বাণী বাহক (সা.)-কে প্রথমে তাঁর সঙ্গী-সাথিদের সাথে পরামর্শ করতে হবে এবং কাজে প্রবৃত্ত হতে হবে। আর এটাই আল্লাহর ইচ্ছা।- মুহসিনে বারকী
৫. ধৈর্যশীল জ্ঞানী লোকদের সাথে পরামর্শের মধ্যেই রয়েছে দিক-নির্দেশনা, অগ্রগতি ও রহমত এবং সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য খোদায়ী মদদ। সদিচ্ছা নিয়ে তোমাকে পরামর্শ দিতে চায় এমন দয়ার্দ্র জ্ঞানী লোককে কখনই প্রত্যাখ্যান কর না। যদি তা কর তাহলে অনেক ক্লেশ ভোগ করতে হবে।- মুহসিনে বারকী
৬. তোমার ঈমানদার ভাইকে জ্ঞান দিয়ে সাহায্য কর, যা তাকে দিক-নির্দেশনা দেবে এবং তোমার মত ব্যক্ত কর, যা কাজকে সংহত করবে।- বিহারুল আনওয়ার
৭. বুদ্ধিমত্তার সাথে পরামর্শ করাই দূরদর্শিতা।- বিহারুল আনওয়ার
৮. পরস্পরের সাথে পরামর্শ করে তোমার বিষয়-আসয় নিষ্পত্তি কর।- তিরমিজি
৯. মহানবী (সা.) আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকে শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।- বুখারী
হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘বিজ্ঞ আলেম, বিশেষজ্ঞ ও খোদাভীরু দূরদর্শী ব্যক্তিই সর্বোত্তম পরামর্শদাতা।’- গুরারুল হিকাম
ইসলামে কেবল একান্ত ব্যক্তিগত বা ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরামর্শের অনুশীলন স্বীকৃত নয়- আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেও পরামর্শের নীতি অনুসরণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে সকল সামাজিক বিষয়ে এই নীতি চর্চার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
যে কোন ধরনের পরামর্শ বা মতবিনিময়ের জন্য স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ইসলাম এই ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। দু’টি ক্ষেত্রে এই সীমাবদ্ধতা বিশেষভাবে লক্ষণীয় :
১. ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ও সুনির্দিষ্ট খোদায়ী অনুশাসন পরামর্শের মাধ্যমে পরিবর্তন করা যাবে না। পরামর্শের মধ্য দিয়ে কেবল এসব হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের পন্থা ও পরিকল্পনা নির্ধারিত হবে।
২. মহানবী (সা.)-এর আদেশ-নিষেধ, ইমামগণ ও বেলায়েতে ফকীহদের মতামত এবং ইসলামী আদালতের বিচারকদের রায় পরামর্শ বা মতবিনিময়ের মাধ্যমে পরিবর্তনযোগ্য নয়।
ইসলামী নীতি অনুসারে পরামর্শ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হতে পারে দু’টি পন্থায় :
১. একটি উপদেষ্টা পরিষদ বা উপদেষ্টা সংস্থা গঠনের মাধ্যমে পরামর্শ ব্যবস্থা চালু হতে পারে- যে পরিষদ বা সংস্থা সরকার বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পরিপূরক ‘চিন্তার ভা-ার’ বা দিক-নির্দেশক হিসাবে কাজ করবে এবং প্রশাসনের সার্বিক বিষয়ের ওপর নজর রাখবে। অবশ্য এই ধরনের পরিষদ বা সংস্থাকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যে কোন ধরনের বাধ্যবাধকতামুক্ত থাকতে হবে। এই পদ্ধতিতে পরামর্শ পরিষদ বা উপদেষ্টা সংস্থা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোন কাজে বাধা দিতে পারে না। তারা কেবল কর্তৃপক্ষের ক্ষতিকর ভুল পদক্ষেপসমূহের ব্যাপারে আইনগত পন্থায় প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে।
২. এছাড়া এমন একটি কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে যে, তারা ব্যবস্থাপনার কোন শাখা পরিচালনার জন্য দায়িত্বশীল থাকবে এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যক্তি বিশেষকে স্থানান্তর করতে পারবে। এই কাউন্সিলকে গ্রুপ বা সম্মিলিত ব্যবস্থা যাই বলা হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তারাই হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বিষয়সমূহ পরিচালনার জন্য দায়িত্বশীল।
পরামর্শের এই দুটি পন্থা ছাড়াও যখনই প্রয়োজন দেখা দেবে তখনই পরামর্শ করতে হবে। অর্থাৎ আশু বা জরুরি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে এবং দীর্ঘমেয়াদী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনে এসবের উপযুক্ত পন্থা অনুসরণ করা যেতে পারে। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে : ‘তোমরা পরামর্শের মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন কর।’ অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘এবং যখন তুমি তোমার মনকে প্রস্তুত করবে (সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে) তখন আল্লাহর ওপর ভরসা রেখ।’ এই আয়াতগুলোতে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, জরুরি পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে এ উভয় পন্থায় পরামর্শ করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে প্রথম ধরনের পরামর্শ ব্যবস্থায় রয়েছে গ্রামীণ পরিষদ, জেলা পরিষদ, নগর পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ। এসব পরামর্শক সংস্থা সরকারি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বা পরিপূরক হিসাবে কাজ করে থাকে।
দ্বিতীয় ধরনের পরামর্শক সংস্থাগুলো হচ্ছে : নেতৃ পরিষদ, অভিভাবক পরিষদ, বিশেষজ্ঞ পরিষদ, মজলিসে শুরা, সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, সুপ্রীম ডিফেন্স কাউন্সিল ও মন্ত্রিপরিষদ।
সকল পরিষদ বা সংস্থাই গঠিত হয় সামরিক, কৃষি বিষয়ক, শিল্পখাত ও প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ববর্গ সমন্বয়ে এবং তাঁরা কাজ করেন উপদেষ্টা হিসাবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (আ.)-এর একটি বাণী বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন : ‘অনিশ্চয়তা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ কর এবং একজন ঘনিষ্ঠজনের কাছে যাও।’ মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনেও দেখা গেছে যে, তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথিদের কাছে মতামত জিজ্ঞাসা করতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজে অটল থাকতে আদিষ্ট হয়েছেন। ইসলামের পরামর্শ নীতির ব্যাপারে আধুনিককালে স্বল্প ধারণার ফলে একে কেবল একটি পরামর্শক সংস্থা হিসাবেই অনুধাবন করা হয়ে থাকে। মনে করা হয়, এটি স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনা মাত্র। বিভিন্ন বিষয় নিষ্পত্তি ও পরিচালনায় ইসলাম নিশ্চিতভাবেই অন্যতর পন্থা অবলম্বনের কথা বলেছে। সার্বিক সাধারণ প্রেক্ষাপটে এসব পদ্ধতি সামষ্টিকভাবে চর্চা করতে হবে এবং এর ভিত্তিতেই এই পরামর্শের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
(নিউজলেটার, মে ১৯৯১)