টেলিভিশনের মতো একটি ইলেক্ট্রনিক আবিষ্কারের ইতিবাচক ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া কী তা ঘনিষ্ঠভাবে তাকিয়ে দেখার এখনই সময়। টেলিভিশন কি আমাদের শিশুদের জন্য কল্যাণকর?
ঘরের ভিতর শান্তশিষ্ট হয়ে বসে আছে একটি ছোট মেয়ে, রান্নাঘরে কর্মরত তার মায়ের নানা কাজের শব্দ তার কাছে মজা লাগছে। মেয়েটির ছোট ভাই মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে আর বড় ভাই চারিদিকে ছড়ানো বইয়ের মধ্যে শুয়ে লেখাপড়া করছে। বাইরে ক্রমবর্ধমান অন্ধকারের মধ্যে নীরবে তুষারপাত হচ্ছে। বাবা এখনও তাঁর কাজ থেকে ঘরে ফিরে আসেননি।
ছোট মেয়েটি টেলিভিশনের আলোকিত পর্দার সামনে মোহাবিষ্ট হয়ে তার বসার জায়গাটির সাথে যেন একেবারে স্থির হয়ে গেছে। তার মন চলে গেছে অনেক দূরে। এমন একস্থানে যা কোনদিন সে দেখেনি। কিন্তু সে বুঝতে পারে সবই। টেলিভিশনের পর্দায় সে দেখছে বরফাবৃত সমতল ভূমির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নায়ক আর তাকে অনুসরণ করছে এক ভয়ংকর ভালুক। আজ সকালেই মেয়েটি তার শ্রেণিশিক্ষকের কাছে শুনেছিল দক্ষিণ মেরুর কথা, যে ছবি তার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে ছিল। এখন তা-ই দেখছে টেলিভিশনের পর্দায়। সে দেখছে তুষার আবৃত ভূমিতে বরফের পাহাড় এবং তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস। তার কাছে সবই যেন এক একটি বাস্তব ঘটনা। সে সবকিছু যেন গলধঃকরণ করছে আর উদ্বেগের মধ্যে কামনা করছে নায়ক যেন ঘুরে অন্য দিকে চলে যায়। কেননা, তার পিছন দিক থেকে কি যেন আসছে! মেয়েটি কল্পনা করে, এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত। হঠাৎ করে ভল্লুকটি গোঁ গোঁ করা শুরু করল আর নায়ক অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে তার রাইফেল তাক করে গুলি ছুঁড়ল। মেয়েটি এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এবং চিন্তা করল ভল্লুকটির কী হলো। টিভি পর্দায় যখনই ভল্লুকটির দৃশ্য দেখা গেল তখনই রান্নাঘর থেকে তার মা তাকে ডাক দিলেন। বিরক্তিভরে মেয়েটি মায়ের ডাক উপেক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মা আবার তাকে ডাকলেন, এবার একটু উচ্চৈঃস্বরে। মেয়েটি যেন জোর করে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল টেলিভিশনের পর্দা থেকে এবং উঠে গেল রান্নাঘরের দিকে। টেলিভিশন তখনও চলছে। মেয়েটির বড় ভাইয়ের দৃষ্টি তার পড়ার কাজ থেকে টেলিভিশনের পর্দার দিকে পড়তেই সে তাড়াতাড়ি তার লেখার কাজ শেষ করল।
হ্যাঁ। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো টেলিভিশন। যোগাযোগের একটি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম বা আলোকিত পর্দা, যা আমাদের দৃষ্টিকে আমাদের গৃহকোণ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। সেই একচোখা দানবটি আমাদের অবকাশের সময়কে খেয়ে ফেলে এবং দাবি করে পূর্ণ নীরবতা ও মনোযোগ। টেলিভিশন আমাদের সমাজে বেশিদিন হলো আসেনি। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই ভুলে যেতে শুরু করেছি, টেলিভিশন ছাড়া বিশ্ব চলতে পারে কিনা। টেলিভিশনের পরিণতি-প্রতিক্রিয়া কী তা আমাদের অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে বুঝার চেষ্টা করেন না; বরং অভ্যাসবশত প্রতিরাতেই আমরা টেলিভিশন সেটের সামনে স্থির হয়ে বসে থাকি। গোটা মানববংশই আজ ঐ টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালার প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে। খাবার খাওয়া হচ্ছে না, বাড়ির কাজ অসম্পূর্ণ থাকছে এবং ঘুম নষ্ট হচ্ছে।
টেলিভিশন একটি সর্বজনীন সান্ত্বনা দানকারী। মায়েদের জন্য এটি এখন একটি উপযুক্ত মাধ্যম হয়ে উঠেছে তাদের ছেলেমেয়েদের শান্ত রাখার। ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে এনে টেলিভিশন সেট চালু করে দিয়েই মায়েরা অনেকটা খালাস।
কিন্তু আমাদের খুব ঘনিষ্ঠভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দরকার যে, এই ইলেক্ট্রনিক আবিষ্কারটির ইতিবাচক ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া কী? গবেষকরা এ নিয়ে যে ব্যাপক গবেষণা সমীক্ষা চালিয়েছেন এবং তাঁরা যে প্রশ্ন ও জবাব নির্ধারণ করেছেন তা বিভিন্ন রকম। টেলিভিশন শিশুদের জন্য কল্যাণকর, নাকি কল্যাণকর নয়? টেলিভিশন দেখে ছেলে-মেয়েরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করে? কী ধরনের অনুষ্ঠান শিশুদেরকে আকৃষ্ট করে এবং কেন করে? বয়স্কদের অনুষ্ঠান দেখে শিশুরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করে? টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কতখানি সহায়ক? টেলিভিশন অনুষ্ঠান কি শিশুদের সামনে এক অবাস্তব জীবনধারা উপস্থাপন করে? টেলিভিশন কি একটি বাণিজ্যিক মানসিকতা সৃষ্টি করে?
টেলিভিশন শিশুদের মধ্যে বহুমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কখনও কখনও টিভি স্টুডিওর দৃশ্য শিশুদের কাছে এতই বাস্তব বলে মনে হয় যে, তারা আশপাশের পরিবেশ সাময়িকভাবে ভুলে যায়। টেলিভিশন যখন শিশুমনকে এতই আলোড়িত করে তখন তা শিশুদের জীবন গঠনেও এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভূমিকা পালন করতে পারে।
যেসব ছেলেমেয়ে টেলিভিশন দেখে তারা যেসব ছেলেমেয়ে টেলিভিশন দেখে না তাদের তুলনায় বিশ্ব সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারে। টেলিভিশন দেখে অভ্যস্ত শিশুরা অনেক বেশি কথা শিখতে পারে এবং নায়ক ও ব্যর্থ নায়কদের আবেগ-অনুভূতিতে একাত্ম হয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। বিশেষত খেলার অনুষ্ঠানে শিশুরা বেশি আগ্রহী হয় এবং নানা প্রশ্ন জবাবের মধ্য দিয়ে যথেষ্ট ধারণা লাভ করে।
কার্টুন ছবি শিশুদের বাস্তব অবস্থা থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিরাট ভূমিকা পালন করে। আর সেজন্য তারা কার্টুন ছবি পছন্দও করে বেশি।
শালীনতার অভাব দেখা দিলেই কেবল টেলিভিশন ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয় এবং একথা সব জিনিসের বেলায়ই প্রযোজ্য। পিতামাতা এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালা প্রণেতা ও পরিচালকদের দায়িত্ব হলো শিশুদের জন্য উপযোগী শালীন ও ভারসাম্যপূর্ণ অনুষ্ঠান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক সময় এ ব্যাপারটি শিশুদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। কোন শিশু যখন চলচ্চিত্র বা অনুরূপ অনুষ্ঠান দেখতে যায় তখন তার সাথে থাকে কোন বয়স্ক ব্যক্তি। কিন্তু টেলিভিশনের বেলায় এমনটি হয় না। পিতামাতারা সাধারণত মনে করে থাকেন যে, টেলিভিশন একটি নিরাপদ বিনোদন মাধ্যম এবং এজন্য বাড়ির অভ্যন্তরে কিছু সময়ের জন্য তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন। কিন্তু শিশুরা যথাযথ নিয়ন্ত্রণ-নির্দেশনা ব্যতিরেকে টেলিভিশন দেখলে তাদের সমস্ত অবকাশের সময় তাতে ব্যয় হয়ে যেতে পারে, পড়ালেখার জন্য খুব সামান্য অথবা একেবারে অল্প সময় পাবে, বাড়ির নির্ধারিত পড়া তৈরি করবে না, শরীরচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে, এমনকি অতিরিক্ত টেলিভিশন দর্শনে সামাজিক যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
টেলিভিশন অবশ্যই একটি চমৎকার যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু তা অনেক সময় আমাদের পরস্পরের প্রত্যক্ষ যোগযোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। টেলিভিশন গবেষকরা অনুষ্ঠানমালা প্রণয়ন এবং শিশুদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রতিদিনই আরো অধিক ধারণা অর্জনের চেষ্টা করছেন। টেলিভিশন এমন একটি মাধ্যম যার অপব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ভালোর জন্যও একটি বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।
একারণে পিতামাতার অবশ্য কর্তব্য হলো শিশুদের প্রয়োজন ও আগ্রহ অনুযায়ী এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা অনুযায়ী একটি শালীন ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি ও নির্দেশনার আলোকে টেলিভিশন পরিচালনা করা।
(নিউজলেটার, নভেম্বর ১৯৯১)