যে আলো কখনও নেভে না
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (সাঃ) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী স্বর্গীয় হুর। প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। একই ধরনের হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিম শরীফ ও আহমদ ইবনে শুয়াইব নাসায়ীর ফাজায়েল গ্রন্থসহ আরো অনেক হাদীস গ্রন্থে। হাদীসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রসূল (সাঃ)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। হযরত ফাতিমা (সাঃ)’র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদীসই যথেষ্ট। বিশ্বনবী (সাঃ)’র আহলে বাইত (আঃ)’র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট।
এখন প্রশ্ন হল, এমন অসাধারণ ও উচ্চতর মর্যাদা কিভাবে অর্জন করেছেন হযরত ফাতিমা (সাঃ)? এটা কি কেবল এ জন্যে যে তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র কন্যা? এমন প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবী (সাঃ)। ফাতিমা যদি নবী-নন্দিনী নাও হতেন তাহলেও নিজ যোগ্যতার কারণেই তিনি এমন শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী হতেন বলে মহানবী (সাঃ) উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ খোদাভীরু, দানশীলা, কর্তব্য-সচেতন, ন্যায়-নিষ্ঠ এবং জ্ঞানী। সর্বোপরি ইসলামের জন্য অসাধারণ ত্যাগ-তিতিক্ষাও তাঁকে পরিপূর্ণ আদর্শ মানব ও শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। সিদ্দিকা বা সত্যবাদী, তাহিরা বা পবিত্র, রাজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, মুবারাকাহ বা জ্ঞান, কল্যাণ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরকতময় প্রভৃতি ছিল হযরত ফাতিমা (সাঃ)’র কিছু উপাধি। রাসূল (সাঃ)’র প্রতি তিনি এত যত্নবান ছিলেন যে তাঁকে বলা হত উম্মু আবিহা বা পিতার মাতৃতুল্য।
এ ছাড়াও হযরত ফাতিমা সিদ্দিকা (সাঃ) ছিলেন একজন আদর্শ জননী, একজন আদর্শ স্ত্রী এবং একজন আদর্শ কন্যা। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন নারীর জন্মকে আরবরা কলংক বলে মনে করতো। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও নারীরা ছিল অবহেলিত ও উপেক্ষিত এবং এমনকি মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। বিশ্বনবী (সাঃ)’র কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় মক্কার মুশরিক আরবরা তাঁকে নির্বংশ বা আবতার বলে উপহাস করত। কিন্তু মহান আল্লাহ এসব উপহাসের জবাব দিয়েছেন সূরা কাওসারে। এ সূরায় হযরত ফাতিমা (সাঃ)কে কাওসার বা প্রাচুর্য্য বলে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ এবং কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। হযরত ফাতিমা (সাঃ)’র মাধ্যমে নবীবংশ বা আহলে বাইত (আঃ)’র পবিত্র ধারা রক্ষিত হয়েছে।
নারী যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখতে পারে সে দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন হযরত ফাতিমা (সাঃ)। তিনি ইমামত বা বেলায়েতের দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলেও হযরত আলী (আঃ) ছাড়া আহলে বাইত (আঃ’র অন্য ১১ জন সদস্য বা পবিত্র ইমামের জন্য তিনি ছিলেন আদর্শিক পূর্বসূরী। বিশ্বনবী (সাঃ)’র ওফাতের পরও তিনি মুসলমানদেরকে পথ-নির্দেশনা দান অব্যাহত রেখেছিলেন। পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সাঃ)’র পবিত্র আহলে বাইত (আঃ)কে অনুসরণ করার জন্য বিশ্বনবীর তাগিদ সত্ত্বেও পিতার ওফাতের পর সৃষ্ট জটিল ও অনাকাঙ্ষিনুত পরিস্থিতি দেখতে পেয়ে তিনি পিতার উম্মতকে পথ নির্দেশনা দেয়ার জন্য বলেছিলেন, তোমরা কেন বিপথে যাচ্ছ? অথচ তোমাদের মধ্যে কোরআন রয়েছে। কোরআনের বক্তব্য ও বিধি-বিধান সুস্পষ্ট। এ মহাগ্রন্থের দেখানো পথ-নির্দেশনাগুলো স্পষ্ট এবং সতর্কবাণীগুলোও স্পষ্ট।
হযরত ফাতিমা (সাঃ) নিজ জীবনে পবিত্র কোরআনের শিক্ষাগুলো বাস্তবায়নে অগ্রণীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। তাঁর মাত্র প্রায় ১৮ বছরের জীবন এ ধরনের অনেক বরকতময় ঘটনায় ভরপুর। যেমন, আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ)’র সাথে তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এক দরিদ্র মহিলা তাঁর কাছে পোশাক চাইলে তিনি তার বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য কেনা নতুন জামাটি উপহার দেন। তিনি ইচ্ছে করলে তার পুরনো জামাও দিতে পারতেন। কিন্তু নবীনন্দিনী এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের কথা স্মরণ করেন, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোনো কিছু দান করার ক্ষেত্রে ও তা কবুল হবার জন্য সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি দান করার কথা বলা হয়েছে। অনেক সময় দেখা গেছে ঘরে খাদ্যের অভাব থাকা সত্ত্বেও স্বামী যাতে বিব্রত না হন, বা গুরুত্বপূর্ণ অন্য কাজে বাধাগ্রস্ত না হন সে জন্য তিনি সে অভাবের কথা তাঁকে জানান নি। এবাদতের পর মুনাজাতের সময় তিনি নিজ ও নিজ পরিবারের জন্য নয় বরং পাড়া-পড়শী ও পিতার উম্মতের জন্য দোয়াকে প্রাধান্য দিতেন। হযরত ফাতিমা (সাঃ) মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটানা তিন দিন নিজের ও নিজ পরিবারের খাবার দরিদ্রদের দান করে শুধু পানি দিয়ে ইফতার করেছিলেন।
আজকাল মুসলিম বিশ্বের অনেকেই নারীমুক্তির কথা বলেন এবং পশ্চিমা নারীদের অনুসরণকেই তারা নারীর মুক্তি ও প্রগতির পথ বলে মনে করছেন। কিন্তু নারীর প্রকৃত মুক্তির পথ যে নবীনন্দিনী (সাঃ) বহু আগেই মানবজাতিকে দেখিয়ে গেছেন তা তারা হয় জানেন না, বা জানার চেষ্টাও করেন না। পারিবারিক অশান্তির জন্য তারা শরণাপন্ন হচ্ছেন মনোবিজ্ঞানীদের। কিন্তু তারা যদি নিজ জীবনে হযরত ফাতিমা (সাঃ)’র আদর্শ অনুসরণের চেষ্টা করতেন এবং তার সাদা-সিধে ও অনাড়ম্বর জীবন থেকে শিক্ষা নিতেন তাহলে আজকের যুগে তালাক প্রবণতা বৃদ্ধিসহ যেসব জটিল পারিবারিক সমস্যা দেখা যায় সেগুলোর সমাধান সহজ হয়ে যেত।
মুসলিম বিশ্ব ও উম্মাহ হযরত ফাতিমা (সাঃ)-কে হারিয়েছিল অত্যন্ত প্রয়োজনের সময় বা অত্যন্ত দূর্দিনে। তাঁর শাহাদত এবং জীবনের রেখে যাওয়া শিক্ষাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবো ও তাঁকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে মুসলিম মা-বোনদেরকে ভালো মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবো-এটাই হোক এই অশেষ শোকের দিনে আমাদের প্রধান প্রার্থনা ও সংকল্প। #