ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা ইসলামের আবির্ভাবকালীন একজন মহিলার কথা জানতে পারি, যিনি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের পর প্রথম হিজরত করেন। এই মহিলার নাম উম্মে কুলসুম। তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশোদ্ভূত। তিনি ঈমান আনয়ন করেন এবং হিজরতের পর মহানবী (সা.)-এর কাছে বাইআত গ্রহণ করেন। সত্যি বলতে কি, কারো পিতা-মাতা ও ভ্রাতাগণ যখন কুফরির মধ্যে জীবনযাপন করে তখন তার মধ্য থেকে মহানবী (সা.) ও তাঁর আদর্শের অনুসারী হওয়ার এক বিরাট মূল্য রয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানুষ তার উত্থান বা পতনের পথ বেছে নেয়ার ব্যাপারে স্বাধীন। এছাড়া মহিলাদের মর্যাদা ও অবস্থানকে গুরুত্ব প্রদান এবং তাদেরকে স্বাধীনতা প্রদান করা হলে তা মহিলাদেরকে ইসলামের খোদায়ী নীতির প্রতি আকৃষ্ট করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। হেজাজের যে প্রান্তরে ইসলামের বাণী উচ্চারিত হয়েছিল, সেখানে সমাজের অন্যান্য শ্রেণির সাথে বহুসংখ্যক মহিলারও অশ্রু ঝরেছিল নীরবে তাদের জীবনযাত্রায় নানা বিড়ম্বনা নেমে আসার কারণে। মহিলাদের মান-মর্যাদার সবচেয়ে বেশি হানি ঘটেছিল সেই সময় যখন পিতারা তাদের কন্যাদের জন্মকালেই জীবন্ত অবস্থায় কবর দিত। সে সময় মেয়েদেরকে মনে করা হতো বোঝা অথবা ভোগের পণ্য। মহানবী (সা.) আবির্ভূত হওয়ার পর তাঁর জীবনের একটি মৌলিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেন মানুষের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা। তিনি মহিলাদেরকে এক অতল গহ্বর থেকে তুলে এনে ইসলামের মহান আদর্শে সিক্ত করেন।
নবুওয়াতী চিন্তাধারার এক বিশিষ্ট শিক্ষার্থী এই ঈমানদার মহিলা ছিলেন মুসলিম মহিলাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিত্ব।
উম্মে কুলসুম ছিলেন আকবাত ইবনে আবু মুইত নামক এক ব্যক্তির কন্যা। মহানবী (সা.)-এর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য আবু মুইত লোক সমাজে বেশ পরিচিত ছিল। সে মক্কায় বহু অপরাধ সংঘটিত করেছিল এবং মুসলমানদের বহু কষ্ট দিত। উবাই ইবনে খালাফ নামে অপর এক ব্যক্তির সে ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আকবাত যখনই কোন সফর থেকে ফিরে আসত তখনই গোত্রের লোকদেরকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাত। এমনি এক সফর থেকে ফিরে সে কয়েকজন মেহমানকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)ও ছিলেন। যখন খাবার প্রস্তুত তখন মহানবী (সা.) তাঁর মেজবানকে বললেন, ‘তুমি যদি আল্লাহর একত্ববাদ এবং আমার নবুওয়াতের উপর ঈমান না আন তাহলে আমি তোমার এই খাদ্য গ্রহণ করব না।’ আকবাত তখন ইসলাম কবুল করে নিল।
আকবাতের বন্ধু উবাই ইবনে খালাফ পরে এই ঘটনা জানতে পারে এবং অসন্তোষ প্রকাশ করে। আকবাত তাকে বলল, ‘আমি আমার ধর্ম পরিবর্তন করিনি। তিনি আমার খাদ্য গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি ছিলেন আমার মেহমান। আর কোন মেহমান আমার বাড়ি থেকে না খেয়ে চলে যাবে তা আমি চাইনি বলেই তিনি যা বলেছেন আমি তা বিশ্বাস করার কথা স্বীকার করেছি।’ তার বন্ধু তাকে বলল, ‘আমি তোমার কথায় সন্তুষ্ট হব না, যতক্ষণ না তুমি তার কাছে গিয়ে তোমার বিশ্বাসের কথা ফিরিয়ে না দিচ্ছ।’
তার কথা শুনে আকবাত খুব রাগান্বিত হয়ে বলল যে, সে তার হারানো ব্যক্তিত্ব পুনরুদ্ধার করবে এবং মহানবীকে অপমান করার জন্য উবাই যা পরামর্শ দিয়েছে সে তাই করবে। কথিত আছে যে, এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয় : যালিম ব্যক্তি সেইদিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম। হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম।’ (সূরা ফুরকান : ২৭ ও ২৮)
উম্মে কুলসুম তাঁর পিতার এই প্রতিক্রিয়ার কথা শুনে খুব লজ্জিত হলেন। তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হলো এবং নিজের মৃত্যু কামনা করলেন। ঐ ধরনের একটি লোকের মেয়ে হিসাবে তিনি আর বেঁচে থাকতে চাচ্ছিলেন না।
অবশ্য উম্মে কুলসুমের জন্য এটাই সর্বশেষ দুঃখ ও লজ্জাজনক খবর ছিল না। তাঁকে এই ধরনের আরো খবর শুনতে হয়েছিল। যেদিন মহানবী (সা.)-এর চাচা হামজা শহীদ হন সেদিন উম্মে কুলসুমের ভাই অলিদ তার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে মদ্যপান করে উৎসব পালন করে।
উম্মে কুলসুম ঐ কুফরি ভূমিতে আর বেশিদিন বসবাস করতে পারেননি। একদিন রাতে তিনি মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মাঝরাতে গভীর অন্ধকারের মধ্যে তিনি জেগে উঠে বিছানা ত্যাগ করেন এবং মক্কা নগরীর পরিস্থিতি আঁচ করার জন্য বাড়ির ছাদে উঠেন। মুহূর্তের জন্য তিনি ভীতবিহ্বল হয়ে পড়েন এবং সাহস হারাতে থাকেন। তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সবকিছু ত্যাগকারী উম্মে সালামার মতো মহিলাদের সাহসিকতা এবং আশ্রয়হীন মুহাজিরদের অটল-অনড় ভূমিকার কথা স্মরণ করে কেঁদে ফেলেন। এসব চিন্তা তাঁকে সাহস জোগায় এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে এই বলে সান্ত্বনা লাভ করেন যে, তিনি নিশ্চয়ই সফল হবেন। শেষ পর্যন্ত এক ঝড়ের মধ্যে তিনি হিজরতের জন্য যাত্রা শুরু করেন। ঝড়ের মধ্যে যাত্রা করার একটি সুবিধা এই যে, ঐ সময় কাফেররা তাঁকে অনুসরণ করতে পারবে না। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর এইভাবে উম্মে কুলসুম গোপনে তাঁর বাড়ি ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন।
উম্মে কুলসুমের ভাইয়েরা একদিন তাঁকে মক্কায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মদীনায় আসে এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে কথা বলে : ‘আমার বোনকে বাড়ি ফিরে যাবার আদেশ দিন। কারণ, সে এক বেপরোয়া মেয়ে।’ এই কথা বলে তারা চোখে অশ্রুভরা ও মহানবী (সা.)-এর জবাবের জন্য অপেক্ষমাণ উম্মে কুলসুমের দিকে তাকাল। মহানবী (সা.) বললেন, ‘মহিলাদের সম্পর্কে তোমরা যা ভাব আসলে তারা তা নয়। তোমার বোন স্বাধীন। সে তোমাদের সাথে ফিরে যেতে চায় না।’ এই কথা শুনে উম্মে কুলসুমের ভাইয়েরা রেগে গেল এবং তাঁকে ছাড়াই বাড়ি ফিরে গেল।
উম্মে কুলসুম ও হিজরতকারী অন্যান্য মহিলা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘হে মুমিনগণ। তোমাদের নিকট মুমিন নারীরা দেশত্যাগী হয়ে আসলে তাদের পরীক্ষা কর, আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মুমিন তবে তাদেরকে কাফেরদের নিকট ফেরত পাঠিও না। মুমিন নারীরা কাফেরদের জন্যে বৈধ নয় এবং কাফেররা মুমিন নারীদের জন্য বৈধ নয়। কাফেররা যা ব্যয় করেছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দিও।’ (সূরা মুমতাহিনা : ১০)
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ঐ মহিলাদের হিজরতই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল যাঁরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিলেন এবং তাঁদের ধর্ম ও বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপারে নয়। সত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উম্মে কুলসুমের সামনে আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না, তাই তাঁর ভাইয়েরা মক্কায় ফিরে আসে এবং উম্মে কুলসুমকে সাথে নেয়ার চেষ্টায় আর কোন জোরাজুরি করেনি।
উম্মে কুলসুম মদীনায় যায়েদ ইবনে হাদেসের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যায়েদ ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি। অবশ্য তাঁদের দাম্পত্য খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যায়, কেননা যায়েদ খুব অল্পদিনের মধ্যে মুতার যুদ্ধে শহীদ হন।
ইসলামের সাফল্যই এসেছে এ ধরনের লোকদের মাধ্যমে যাঁরা আদর্শের জন্য সংগ্রাম-সাধনা করেছেন। জীবনে সাফল্য লাভ এবং ঈমানের মজবুতি আনার জন্য আমাদের উচিত এই ধরনের মানুষের পথ অনুসরণ করা।
(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯২)