হযরত ইউসুফ (আ.)-এর গল্প

কোরআনে বর্ণিত সুন্দরতম গল্পগুলোর একটি হলো হযরত ইউসূফ (আ) এর গল্প। এই গল্পটি বিশ্লেষণার্থে আমরা কোরআনের গল্পের শিল্পপ্রকরণ নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।একটা গল্পকে আকর্ষণীয় ও পাঠকগ্রাহ্য করে তোলার জন্যে যেসব উপাদান প্রয়োজনীয়,নিঃসন্দেহে ইউসূফ (আ) এর কাহিনীতে সে সব মৌলিক উপাদানের সবটাই রয়েছে। সূরা ইউসূফে মোট ১১১ টি আয়াত রয়েছে। প্রথম তিনটি আয়াত এবং শেষের দশটি আয়াত কাহিনী বহির্ভুত। বাকি আয়াতগুলোতে ইউসূফ (আ) এর জীবন কাহিনী একটানা বর্ণিত হয়েছে। ইউসূফ (আ) এর কাহিনীটির গুরুত্ব হলো-এটা বেশ আকর্ষণীয় এবং উত্তেজনাকর। কেননা এই গল্পটি মানুষের দৈহিক একটি স্বাভাবিক চাহিদাকে কেন্দ্র করে অগ্রসর হয়েছে। ঈর্ষাপরায়নতাও এই গল্পের আরেকটি মূল উপাদান। ইউসূফের ভাইদের ঈর্ষাপরায়নতার মধ্য দিয়ে গল্পটি শুরু হয়েছে।
একটি স্বপ্ন দিয়ে গল্পের শুরু। স্বপ্নটির কথা ইউসূফ (আ) তাঁর বাবাকে বলেন। বলেন যে তিনি স্বপ্নে দেখেছেন চাঁদ এবং সূর্য আর এগারোটি নক্ষত্র তাঁকে সিজদা করছে। তাঁর বাবা হযরত ইয়াকুব (আ) বললেনঃ স্বপ্নের কথাটি তোমার অন্য ভাইদেরকে বলো না! তাতে শয়তান তোমাদের মাঝে ফাটল সৃষ্টির সুযোগ পাবে। মানবীয় গল্পে স্বপ্ন একটা প্রভাবশালী উপাদান। গল্পকারগণ এই উপাদানটিকে একটি টেকনিক হিসেবে কাজে লাগিয়ে থাকেন। স্বপ্ন নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে,আমরা সেই বিশ্লেষণে না গিয়ে বরং বলতে পারি স্বপ্ন যে বাস্তব একটি ব্যাপার প্রতিটি সুস্থ-সবল স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষই তার প্রমাণ। স্বপ্নের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও আধুনিক মনোবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গল্পকারগণ সেজন্যেই বহু গল্পে স্বপ্নের ব্যবহার করেছেন। ইউসূফ (আ) এর গল্পেরও বহুলাংশ জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন। তিনি স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা করেছেন তার বাস্তব ফলাফল দিয়েই গল্পের বিকাশ ঘটেছে। আধুনিক গল্প বিকশিত হয় বৃত্তের পর বৃত্তের মধ্য দিয়ে। ইউসূফ (আ) এর গল্পেও কাহিনী বিকশিত হয়েছে বিচিত্র বৃত্তের মাধ্যমে। বিভিন্ন ব্যক্তির স্বপ্ন এই বৃত্তগুলো তৈরি করেছে।
ইউসূফ (আ) কে তাঁর ভাইয়েরা গর্তে ফেলে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে গল্পে টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে যায়। একটি কাফেলা তাঁকে খুঁজে পেয়ে মিশরে নিয়ে যায়। আজিজে মেস্র ইউসূফ (আ) কে দাস হিসেবে কিনে নেয়। আজিজে মেস্রের স্ত্রী যোলাইখা ইউসূফের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং স্বামীর অধিকারের খেয়ানত করার পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু ইউসূফ (আ) যোলাইখার প্ররোচনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। তার প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাঁকে শেষ পর্যন্ত কারাবাস করতে হয়। কারাগারে তিনি দুই বন্দীর স্বপ্নের যথার্থ ব্যাখ্যা করেন। তারপর মিশরের রাজারও যথার্থ ব্যাখ্যা দিয়ে কারামুক্ত হন। তিনি মিশরের মন্ত্রীত্বের পদেও আসীন হন। তিনি ভাইদেরকে ক্ষমা করে তাঁর বাবা-মাকেও মিশরে আমন্ত্রণ জানান। কোরআনের এই অসাধারণ গল্পটি ইউসূফ (আ) এবং তাঁর পূর্ববর্তীদের কাহিনী থেকে শিক্ষা গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়ে শেষ হয়েছে।
গল্পের শিল্পগত আঙ্গিক বা প্রকরণ বিচার করলে আমরা লক্ষ্য করবো যে অত্যন্ত চমৎকার একটি গতি রয়েছে এর কাহিনীর বুননে। সেইসাথে প্রতিটি ঘটনার সাথে রয়েছে পারস্পরিক সম্পর্ক।অর্থাৎ কোনো একটি ঘটনাও আরোপিত কিংবা অপ্রাসঙ্গিক নয়। ঘটনাগুলো কখনো সমান্তরালভাবে এগিয়েছে আবার কখনো শাখানদীর মতো স্বতন্ত্রভাবে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পুনরায় মূল নদীতে এসে মিশেছে। প্রতিটি গল্পই একটা নির্দিষ্ট বিষয় বা চিন্তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। তবে কখনো আবার মূল চিন্তাকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়োজনে অন্য উপাদানও ব্যবহার করা হয়েছে। ইউসূফ (আ) এর গল্পের মূল উপজীব্য হলো এ বিষয়টি বোঝানো যে,আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর মনোনীত বান্দা এবং ঈমানদার বান্দাদেরকে তাদের দুর্দিনে একাকী ছেড়ে যান না বরং তাদেরকে পর্যায়ক্রমে হেদায়াত করেন এবং বিপদ-আপদে সাহায্য করেন। আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল মানুষ যদি অতল গহ্বরেও নিপতিত হয়,কিংবা কারাগার অথবা প্রাসাদেও নীত হয়,সে সবই আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে থাকে বলে মনে করতে হবে এবং সেগুলো ঘটে নিজেদের পূর্ণতা ও বিকাশের জন্যেই।
ইউসূফ (আ) এর গল্পের মূল বিষয়ের বাইরেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যান্য বিষয়েরও অবতারণা হয়েছে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে : মানুষের সাথে শয়তানের সুস্পষ্ট শত্রুতা, প্রতারকের আপন জালে আটকা পড়া,মানুষের ব্যাপারে আল্লাহর মনোযোগ,আল্লাহর রহমতের ব্যাপারে হতাশ না হওয়া এবং জালেমদের পরাজয় ও ব্যর্থতার অবশ্যম্ভাবিতা। গল্পে সাধারণত মূল চরিত্রের চিন্তাদর্শের সাথে অন্যদের চিন্তা ও কর্মের একটা বিরোধ থাকে,যার মধ্য দিয়ে কাহিনী পরিনতির দিকে অগ্রসর হয়। এই গল্পেও তিন ধরনের বিরোধ বা সংঘাত আমরা লক্ষ্য করবো। মানুষের সাথে মানুষের সংঘাত,প্রকৃতির শক্তির সাথে মানুষের সংঘাত এবং মানুষের আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের সাথে তার নিজস্ব বিরোধ।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিরোধটি ছিলো আজিজে মেসরের স্ত্রীর সাথে ইউসূফ (আ) এর দ্বন্দ্ব। যোলায়খা ইউসূফ (আ) কে দিয়ে আপন কামনা চরিতার্থ করতে চায় কিন্তু ইউসূফ (আ) ঈমানী শক্তির বলে খোদাভীতির কারণে যোলায়খার ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকে।যারফলে পরবর্তী ঘটনাপঞ্জীর জন্ম হয়। এই বিরোধ যতোই চরমে ওঠে ততোই কাহিনী হয়ে ওঠে গতিময় ও রহস্যময়। একটার পর একটা গ্রন্থির মধ্য দিয়ে জটিল হয়ে ওঠে কাহিনীর বুনন। যার ফলে পুরো গল্পটাই পাঠকদেরকে রহস্যের কৌতূহলে উদ্দীপ্ত করে রাখতে সক্ষম হয়।
কথা সাহিত্যিকগণ গল্পের ভেতর চরিত্র সৃষ্টি বা চরিত্রায়নের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। সেজন্যে গল্পের ভেতর বিচিত্র বর্ণনার মাধ্যমে মূল চরিত্রের ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন। কথাশিল্পের পরিভাষায় এটাকে কারেক্টারাইজেশান বলে। কখনো সংলাপের মাধ্যমে আবার কখনো তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। তাই গল্পের মূল চরিত্রটিকে খুব সহজেই একজনন পাঠক আবিষ্কার করতে পারে কেননা মূল চরিত্রের শারিরীক,মানসিক বৈশিষ্ট্য,তার স্বাভাবিক প্রবণতা,নীতি-নৈতিকতা এমনকি তার সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি সকল বিষয় গল্পে উঠে আসে। ইউসূফ (আ) এর গল্পে আমরা লক্ষ্য করবো পুরো কাহিনীটিই বৃত্তায়িত হয়েছে ইউসূফকে কেন্দ্র করে। ঘটনার মূলে প্রধান ভূমিকাটাই হলো ইউসূফের। ইউসূফকে পাঠকরা খুব সহজেই আবিষ্কার করতে পারে। তাঁর পূত-পবিত্র আত্মা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই ধাবিত হয় এবং তিনি তাঁর সক্ষমতাকে বা সামর্থকে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়ে কাজে লাগিয়েছেন।
রেডিও তেহরান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.