১০ রজব ইমাম তাকী (আ.)-এর জন্মদিবস

১০ রজব নবুওয়াতী ধারার নবম ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-এর জন্মদিন। ১৯৫ হিজরির ১০ রজব শুক্রবার মদীনায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম ছিল মুহাম্মাদ এবং উপাধি ছিল আল-জাওয়াদ ও আত-তাকী। পঞ্চম ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকের (আ.)-কে আবু জাফর’ বলে ডাকা হতো এবং সে মোতাবেক ইতিহাসবিদগণ এই ইমামকে দ্বিতীয় আবু জাফর’ বলেও উল্লেখ করেছেন।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-এর পিতা ছিলেন অষ্টম ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.) এবং তাঁর মাতার নাম ছিল সাবিকাহ বা খাইজুরান।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.) চার বছর পর্যন্ত তাঁর পিতার কাছে লালিত-পালিত হন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইমাম রেযা (আ.) তাঁর শিশু পুত্রকে ফেলে মদীনা থেকে খোরাসানে (ইরান) হিজরত করেন। তিনি তদানীন্তন শাসকদের স্বেচ্ছাচারিতা সম্পর্কে এই মর্মে পূর্ণ মাত্রায় সচেতন ছিলেন যেতাঁকে আর কখনও মদীনায় ফিরতে দেয়া হবে না। তাই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় পুত্র মুহাম্মাদ আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-কে তাঁর উত্তরাধিকার নিযুক্ত করে যান এবং তাঁকে তাঁর কাছে রক্ষিত সকল খোদায়ী জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক গুণ শিক্ষা দিয়ে যান।

ইমাম আলী রেযা (আ.)-কে ২০৩ হিজরির ১৭ সফর বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় এবং সেদিন থেকে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.) ইমামতের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। মাত্র আট বছরে এই কিশোর-ইমামের উচ্চতর জ্ঞান ও বাস্তব সাফল্য অর্জনের দৃশ্যত কোন উপায় ও সুযোগ ছিল না। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ফিকাহহাদিস ও তাফসীর ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সমসাময়িককালের আলেমদের সাথে বাহাসে (যুক্তিতর্কে) অংশ নিয়ে তাঁদের পরাজিত করে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং সকলের প্রশংসা লাভ  করেন। সেই সাথে লাভ করেন শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতা অর্জনের স্বীকৃতি।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-এর জীবনকাল ছিল তাঁর পূর্বসূরি ও উত্তরসূরির তুলনায় সংক্ষিপ্ত। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি ইমাম হন আর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। অবশ্য তিনি অনেক সাহিত্য-কর্ম রেখে গেছেন এবং বিপুল শ্রদ্ধা ও ভক্তি লাভ করেছেন।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.) ছিলেন মহানবী (সা.)-এর সদগুণাবলি ও ইমাম আলী (আ.)-এর জ্ঞানের প্রতীক। সাহসিকতাবলিষ্ঠতাদানশীলতাজ্ঞানচর্চাক্ষমাশীলতা ও সহনশীলতা ছিল তাঁর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া গুণ।

আব্বাসী শাসক আল-মামুন তার সাম্রাজ্যকে সংহত করার জন্য আহলে বাইতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ইরানীদের সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ঘটনাক্রমে সে বনু আব্বাসের বন্ধুত্ব ছেড়ে বনু ফাতেমার সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এবং সে মোতাবেক শিয়াদের আনুকূল্য লাভ করে। এক পর্যায়ে সে ইমাম আলী রেযা (আ.)-কে তাঁর উত্তরাধিকার ঘোষণা করে এবং তাঁর বোন উম্মুল হাবীবাকে ইমাম রেযা (আ.)-এর সাথে বিয়ে দেয়। আল-মামুনের ধারণা ছিল ইমাম আলী রেযা (আ.) রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কর্মকা-ে তাকে সমর্থন ও সহায়তা দেবেন। কিন্তু যখন সে দেখল যেরাজনৈতিক বিষয়াবলিতে ইমামের আগ্রহ কম এবং জনসাধারণও তাঁর আধ্যাত্মিক মহত্ত্বের কারণে তাঁর প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েছে এবং আনুগত্য পোষণ করছে তখন প্রতিহিংসাবশত আল-মামুন ইমাম আলী রেযা (আ.)-কে বিষ প্রয়োগ করে। কিন্তু যে সংকটের কারণে ইমাম আলী রেযাকে তাঁর উত্তরাধিকারী ও স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেছিল তা থেকেই গেল। এ সময় সে তাঁর কন্যা উম্মুল ফাজলকে ইমাম মুহাম্মাদ আল-জাওয়াদ আত-তাকীর সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য মনস্থির করে। এই লক্ষ্যে সে ইমাম আত-তাকী (আ.)-কে ডেকে পাঠায়।

বনু আব্বাসের লোকেরা যখন জানতে পারল যেআল-মামুন তার কন্যাকে ইমাম মুহাম্মাদ আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-এর সাথে বিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে তখন তারা তা ব্যর্থ করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। তারা শীর্ষস্থানীয় লোকদের নিয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় মামুনের কাছে যেন তার সিদ্ধান্ত বাতিল করে কিন্তু মামুন ইমাম জাওয়াদের শিক্ষা ও গুণের প্রশংসা করতেই থাকে। সে বলে যেইমাম মুহাম্মাদ জাওয়াদ বয়সে তরুণ হলেও জ্ঞানগত গভীরতার দিক দিয়ে তাঁর পিতার সত্যিকার উত্তরাধিকারী। ইসলামী বিশ্বে কেউ তাঁর সমকক্ষ হতে পারবে না। ইমামের শিক্ষা ও জ্ঞানগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি আল-মামুনের এই প্রশংসার কথা জানতে পেরে আব্বাসীরা ইমামের মোকাবিলায় বাগদাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প-িত ও আইনজ্ঞ ইয়াহিয়া ইবনে আকসামকে বাছাই করে।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আল-মামুন প্রতিযোগিতার জন্য এক মহাসমাবেশের আয়োজন করে। তাতে যোগ দেয় দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। এছাড়াও ঐ সমাবেশে জ্ঞানী ও প-িতদের জন্য নয়শ’ চেয়ার সংরক্ষণ করা হয়েছিল। গোটা বিশ্ব যেন তখন বিস্ময়ের সাথে প্রতীক্ষা করছিল যেএকজন তরুণ কিভাবে ইরাকের ধর্মীয় ও বিচার বিভাগীয় একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে প্রতিযোগিতা করবেন।

একদিন ইমাম মুহাম্মাদ আল-জাওয়াদ (আ.) মামুনের সিংহাসনের পাশে ইয়াহিয়া ইবনে আকসামের মুখোমুখী বসেছিলেন। ইয়াহিয়া ইমামকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি কি আমাকে একটি প্রশ্ন করার অনুমতি দেবেন?’ ইমাম উত্তরে তাঁর প্রৌঢ় প্রতিপক্ষকে বললেন, ‘আপনার যা ইচ্ছা তাই জিজ্ঞাসা করতে পারেন।

এই বাহাসে ইমাম মুহাম্মাদ আল-জাওয়াদ (আ.) তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়াহিয়া ইবনে আকসামের সকল প্রশ্নের জবাব দেন। কিন্তু ইমামের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি ইয়াহিয়াবরং ইয়াহিয়াকে করা ইমামের প্রশ্নের জবাবও ইমাম দিয়ে দেন।

তখন মামুন সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় বলে, ‘আমি কি আগেই বলিনি যেইমাম মুহাম্মাদ আল-জাওয়াদ এমন এক পরিবার থেকে এসেছেনযাকে জ্ঞান ও শিক্ষার ভা-ার হিসাবে আল্লাহ তাআলা বাছাই করেছেন। এই পরিবারের শিশুদের সাথেই এঁটে উঠতে পারেএই পৃথিবীতে এমন কেউ আছে কি?’ সমবেত সকলেই সমস্বরে বলে উঠল, ‘নানামুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকীর সমকক্ষ কেউ নেই।

একই সমাবেশে আল-মামুন তার কন্যা উম্মুল ফাজলকে ইমামের সাথে বিয়ে দেয় এবং আনন্দের নিদর্শন হিসাবে তার অধীনদের মধ্যে উদারহস্তে দান ও উপহার বিলাতে থাকে। বিয়ের এক বছর পর ইমাম সস্ত্রীক বাগদাদ থেকে মদীনায় ফিরে যান এবং আল্লাহ তাআলার হুকুম-আহকাম প্রচারের কাজ শুরু করেন।

আল-মামুনের ইন্তেকালের পর আল-মুতাসিম সিংহাসনে আরোহণ করে। এতে সে ইমামের উপর অত্যাচার চালানোর সুযোগ পায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করে। আল-মুতাসিম ইমামকে বাগদাদে তলব করে। ২২০ হিজরির ৯ মুহররম ইমাম বাগদাদে পৌঁছান। আল-মুতাসিম ঐ বছরই ইমাম জাওয়াদ (আ.)-কে বিষপ্রয়োগ করে। তিনি ২৯ জিলক্বদ শাহাদত বরণ করেন। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-জাওয়াদ আত-তাকী (আ.)-কে বাগদাদের উপকণ্ঠে আল-কাযিমিয়াতে তাঁর পিতামহ সপ্তম ইমাম মূসা কাযিম (আ.)-এর মাজারের পাশে দাফন করা হয়।

(নিউজলেটারজানুয়ারি ১৯৯২)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.